
দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে অনাবৃষ্টি এবং রোদের তীব্র তাপপ্রবাহে জনজীবন দূর্বিষহ হয়ে পরেছে।
সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চল হয়েও যেনো অসহায়! অনাবৃষ্টি এবং দুই তৃতীয়াংশ খাল শুকিয়ে যাওয়ায় পানির তীব্র সঙ্কটে কৃষকরা তিন ফসলি জমিতে সেচ দিতে না পারায় করতে পারছেন না মৌসুমী বীজতলাও। অসহনীয় গরমে পানির উত্তপ্ততা বেড়ে যাওয়ায় উপকূলের কাছাকাছি মাছ পাচ্ছে না জেলেরা। এবং দিনমজুর সহ অন্যান্য ক্ষুদ্র পেশার নিম্ন আয়ের মানুষেরা কর্মহীন হয়ে পরেছে।
দেশের সর্ব দক্ষিনের পটুয়াখালী ও বরগুনা সহ সকল উপকূলীয় অঞ্চলের সমুদ্র পার্শবর্তী এলাকাগুলোতে অনাবৃষ্টির আকাল পরেছে। এই অনাবৃষ্টির প্রভাবে জনজীবন ও দেশের অর্থনৈতিক খাত রয়েছে বিপর্যয়ের মুখে। জেলা আবহাওয়া আধিদপ্তর সুত্রে জানা গেছে, সারা দেশে মাঝারি ও তীব্র গরম বয়ে যাচ্ছে যা বেশকিছুদিন অব্যাহত থাকবে, তবে আগামী ৪৮ ঘন্টার মধ্যেও বৃষ্টিপাত হওয়ার আশঙ্কা নেই।
এতে উপকূলে একদিকে কৃষকরা আউশ ধান সহ মৌসুমী ফসলের বীজতলা পানির অভাবে চাষযোগ্য করে তুলতে পারছে না। অন্যদিকে জেলেরা সমুদ্রে গিয়ে ফিরছেন খালি হাতে! তীব্র গরমে স্বাভাবিক পানির ঊষ্ণতা বেড়ে যাওয়ায় ইলিশ সহ অধিকাংশ মাছ সমুদ্রের গভীর পানিতে চলে গেছে। যার ফলে উপকূলের জেলেদের জালে ধরা পরছে না মাছ। তীব্র গরম ও অনাবৃষ্টির কারনে উপকূলীয় অঞ্চলের দিনমুজুর সহ সংশ্লিষ্ট পেশাজীবি এবং ক্ষুদ্র পেশার সাথে জড়িত নিম্ন আয়ের হাজার হাজার মানুষের জীবনে হাহাকার বেরেছে; কর্মহীন অবস্থায় দূর্বিষহ হয়ে পরেছেন তারা। উপকূলে পর্যটন শিল্প, কৃষি ও মৎস্য খাতে দেশের অর্থনিতীতে এর প্রভাব পরবে বলে জানা যায়। ঐদিকে রৌদ্রতাপে উপকূলের অনেক পরিবারে মানুষের ডায়রিয়া সহ অসুস্থতা বেড়েছে।
উপকূলের কয়েক জেলার মৎস্য উৎপাদন খাত থেকে একদিকে সরকার রাজস্ব পায়, অন্যদিকে কর্ম পেশাজীবি মানুষদের কর্মসংস্থান থাকায় তারা সাবলম্বী হয়; দেশ এগিয়ে চলে সমৃদ্ধিতে।
তবে চলমান বছরে দেখা গেছে এই উপকূল অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ মৎস্য খাত যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, সঠিক সময়ে উপযোগী কৃষি ফলন হচ্ছেনা, খেটেখাওয়া সাধারন মানুষ সহ জনজীবনে অর্থনৈতিক মন্দায় পড়েছে বিরূপ প্রতিক্রিয়া। যা দেশের চলমান অর্থনৈতিক গতিশীলতায় ধাক্কা লাগবে বলে অভিমত সাধারন মানুষের।
কৃষক হাবিব মৃধা, আইউব আলী খলিফা সহ অনেকে বলেন, দেশের বর্তমান উর্ধ্বগতির বাজারে জিনিসপত্রের যে দাম বেড়েছে তা ক্রয় করে সংসার চালাতে রিতিমতো হিমশিম খেতে হচ্ছে। অন্যদিকে সার ও ঔষধের দামও বেড়েছে, ফলে ফসল উৎপাদন করে খরচের টাকা উঠানোই দায় হয়ে যায়, তার মধ্যে খাল শুকিয়ে গেছে এবং অন্যদিকে বৃষ্টিপাত নেই! এ আবস্থায় কারো কাছে আর্থিক সহায়তাও পাচ্ছি না, যা দিয়ে মোটামুটি সংসার চলবে। বর্তমানে আমরা কৃষকরা চরম বেকায়দার মধ্যে পড়ে গেছি বলে জানান তারা।
জেলে ইউসুফ হাওলাদার বলেন, একদিকে ঋনের বোঝা টানতে হয়, অন্যদিকে আরদ মালিকের লাখ লাখ দাদনের টাকায় জর্জরিত হয়ে বছরের পর বছর ধইরা অভাবের মধ্যে কেটে যাচ্ছে! এখন তিনবেলা ঠিকমতো দুমুঠো ভাত খেতে পারছি না। চাইছিলাম এবছর মালিকের দাদনের টাকা পরিশোধ কইরা অন্য পেশায় যামু, তাও সাগরে গিয়ে মাছ পাই না; যা পাই তা থেকে খরচের টাকাই উঠানো দায়! দাদনের টাকা না দিলে আমাগো এই পেশা ছেড়ে যাওনের উপায় নেই। একদিকে সংসারে টানপোড়ন অন্যদিকে সাগরে মাছ নেই।
দিনমজুর জবুল হক বলেন, দীর্ঘ যুগ ধইরা দিনমজুরির কাজ করলেও আমার কৃষি পেশা ভালো লাগে, তাই এই করে আসছি। কিন্তু বর্তমানে বৃষ্টিপাত না থাকায় এই সময় আমাকে কেউ কাজে ডাকছে না, দু’এক জায়গায় ডাকলেও গরমে হাসফাস অবস্থায় ঠিকমতো কাজ করা সম্ভব হয় না। তাই বেশিরভাগ সময় কাজকাম ছাড়াই কাটাই। ঐদিকে সংসারে টানপোড়ন লেগে আছে; যেমন নুন আনতে পানতা ফুরায়!
সমুদ্র সৈকতের চা-পান বিক্রেতা মীর জসিম এর সাথে কথা হলে তিনি জানান, আগে সর্বনিম্ন ৩-৪০০ টাকা লাভ হলেও বর্তমানে এই পরিমান টাকা বিক্রিই হচ্ছে না! কোনোদিন ১০ টাকা, আবার কোনোসময় মোটেও বিক্রি হয়না। একমাত্র কর্মক্ষম ব্যাক্তি হিসেবে এই সামান্য আয় দিয়ে সন্তানাদি সহ সংসারে ভড়নপোষন কিভাবে চালামু ভেবেই কোনো উপায় পাচ্ছিনা! খুব হতাশ অইয়া গেছি, আর পরিবারের কাউকে বুজাতেও পারছি না কিভাবে সময় যাচ্ছে। কোথায় যাবো? কি করবো? ভাবছি এসব ছেড়ে দিনমজুরির কাজ করমু কিছুদিন তাও পাচ্ছি না। ঐ দিকে ঋনের বোঝায় রয়েছে এ আরেক যন্ত্রনা।
খাবার হোটেল মালিক মুজিবুর রহমান জানান, তিন দিনে ২৫০ টাকার বেচা বিক্রি হইছে। অথচ ঋনের টাকার কিস্তি পরিশোধের জন্য লোক আসছে। সপ্তাহের ব্যাবধানে ১৫ হাজার টাকা দেনা হইছি। এখন মাত্র ৩০ টাকা পকেটে নিয়ে হোটেল বন্ধ করে ঘুরছি।
ফটোগ্রাফার আলমাস জানান, প্রতিদিন কম হলেও পাঁচ’শ থেকে এক হাজার টাকা আয় হতো। তবে বর্তমানে ২-৩০০ টাকাও আয় হয় না আবার দেখা গেছে এ পেশায় জড়িত অনেকেই শুন্য হাতে বাড়ি ফিরে গেছে। তীব্র গরমে কিছু সংখক পর্যটকের আনাগোনা থাকলেও তারা সৈকতে গোসল করেই রুমে চলে যান। কেউ ছবি তুলছেন না। কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতে পর্যটন সংশ্লিষ্ট অন্যান্য পেশায় জড়িত আমাদের কয়েক শতাধিক মানুষের জীবনে চলছে করুন হাহাকার।
বিগত বছরের তুলনায় বোরো ধান ২০০-৩০০ কেজি হেক্টর প্রতি বাড়লেও অনাবৃষ্টি এবং তীব্র তাপপ্রবাহে মৌশুমী ফসল সহ আউশ ধানের চাষ কিছুটা কমেছে বলে জানান কলাপাড়া উপজেলা কৃষি অফিসার মোঃ সাইফুল। তবে তীব্র গরম ও অনাবৃষ্টির কারনে কৃষকদের ফসল চাষে কিছুটা ঘাটতি বেড়েছে। শ্রমিক সঙ্কটে মুখডাল ও হারব্রেষ্ট উৎপাদনও কিছুটা কমেছে। তবে এবছর ভুট্টা ও সূর্যমুখীর ফলন ভালো হয়েছে বলে জানান তিনি।
প্রতি বছরের তুলনায় এবছর আলিপুর-মহিপুর মৎস্য বন্দর ছাড়াও অনেক জেলায় উৎপাদন কমেছে। এতে সরকারের মৎস্য শিল্প খাতে কিছুটা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এই বছরে মাছের ভরা মৌসুমে সমুদ্রে মাছ কম পাওয়া যাচ্ছে বলে জানান কলাপাড়া উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা অপু সাহা। তিনি আরো বলেন, উপকূলে মাছ কমে গেলেও গভীর সমুদ্রে বড় ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে যা মন প্রতি ৪০-৪৫ হাজার টাকা দরে আগে বিক্রি হলেও বর্তমানে তা ৮০-৮৫ হাজার টাকা দরে বিক্রয় হচ্ছে যেখান থেকে সরকারি রাজস্ব আদায়ে তেমন বেশি একটা তফাৎ নেই, তবে সমুদ্রে মাছ কমেছে এটা ঠিক।
কলাপারা উপজেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রোকৌশলী খালিদ বিন ওয়ালিদ জানান, কৃষকদের পানির চাহিদা পূরনে এবং নিষ্কাশন ব্যাবস্থায় সারাদেশে খাল খনন প্রকল্পের আওতায় রয়েছে, তার আনুমোদন পেলেই আমরা যথাযথ পদক্ষেপ নিতে পারবো।
আবহাওয়া আধিদপ্তর পটুয়াখালী জেলা কর্মকর্তা মাহবুবা সুখী জানান, তীব্র তাপপ্রবাহে দক্ষিন বঙ্গোপসাগর তৎসংলগ্ন এলাকা দক্ষিন আন্ধমান সাগরে একটি সুস্পষ্ট লঘুচাপ সৃষ্টি হওয়ায় এটি ঘনিভূত হয়ে ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিতে পারে। তাপপ্রবাহ এবং অনাবৃষ্টির কারনে জনজীবনে এর ব্যাপক প্রভাব পরেছে। তীব্র গরমে মানুষের ডায়রিয়া আধিকহারে বেড়ে যেতে পারে। তবে আবহাওয়া অনুকূলে না আসা পর্যন্ত উপকূলের জেলেদের অপেক্ষা করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। এই আবহাওয়ার মধ্যে গভীর সমুদ্রের জেলেদের মাছ শিকারের সুযোগ থাকলেও উপকূলের কাছাকাছি অবস্থান করতে বলা হয়েছে পরবর্তী নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত।
তবে আবহাওয়ার বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে জানা যায়, গভীর সমুদ্রে অবস্থানরত সকল নৌযানগুলোকে উপকূলে ভিড়তে বলা হয়েছে।’
বুধবার সকালে ঘূর্ণিঝড়ের বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে। এতে আরও বলা হয়েছে, গভীর নিম্নচাপ কেন্দ্রের ৪৮ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ৫০ কিলোমিটার, যা দমকা অথবা ঝোড়ো হাওয়ার আকারে ৬০ কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। গভীর নিম্নচাপ কেন্দ্রের নিকটবর্তী এলাকায় সাগর উত্তাল রয়েছে৷
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রনালয় সূত্রে জানা যায়, ‘এটা সুপার সাইক্লোন হবে, এমন পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় মোখা শনিবার (১৩ই মে) দিবাগত রাত থেকে রবিবার (১৪ই মে) ভোরের দিকে আঘাত হানতে পারে। ‘অতি প্রবল’ ঘূর্ণিঝড়টি আছড়ে পড়তে পারে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব তথা চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার এবং মিয়ানমারের উপকূলে। এসময় বাতাসের গতিবেগ থাকতে পারে ঘণ্টায় ১৮০ থেকে ২০০ কিলোমিটার।
মন্তব্য করুন