
দেশের সর্বদক্ষিণের উপকূলীয় অঞ্চলের একমাত্র খাপড়াভাঙা নদীটিতে প্রভাবশালীদের দখল, নানা বর্জ্য, পলিথিন ও প্লাস্টিকের দূষণে ভরাট হয়ে মরে যাচ্ছে দু’মাথা সমুদ্রে মিলিত দোনটি। সমুদ্রের শেষ ভাটায় মালবাহী ট্রলার, ষ্টিমার ও মাছ ধরার বড় ট্রলার নদীতে প্রবেশ করতে পারে না। জোয়ারের জন্য অপেক্ষা করতে হয় সমুদ্র মোহনায়। ফলে উপকূলীয় অঞ্চলের পরিবেশের ভারসাম্য হারাচ্ছে এবং জনজীবনে এর প্রকট প্রভাব বিস্তার করেছে।
পটুয়াখালী জেলার মহিপুর থানার লতাচাপলী-মহিপুর এবং ধুলাসার-ডালবুগঞ্জ ইউনিয়নের মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া খাপড়াভাঙ্গা নদীটি কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় মরে যাচ্ছে উপকূলীয় অঞ্চলের একমাত্র নদীটি।
নদীটি রক্ষায় কোনো উদ্যোগ না থাকায় এ সুযোগে দু’পাশের (আলিপুর-মহিপুর) দখলদাররা গলাটিপে হত্যা করছে নদীটি। ফলে এ অঞ্চলের মৎস্যজীবী জেলেরা হারাচ্ছে পোতাশ্রয় এবং উপকূলসহ পর্যটন নগরীর বাসিন্দারা রয়েছে বেকায়দায়।
পরিবেশবাদীরা বলছেন অতিদ্রুত নদীটিকে রক্ষা করা না গেলে অদূর ভবিষ্যতে উপকূল ও পর্যটনে নগরীসহ দেশের অর্থনীতিতে ব্যপক ক্ষতিগ্রস্থ হবে।
কিন্তু নদীটি কবে নাগাদ খনন করা হবে এর কোন সঠিক জবাব দিতে পারেনি পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)।
সরেজমিনে দেখা গেছে, রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় অনেক প্রভাবশালীরা নদীর তীরের মাটি কেটে বাধ দিয়ে ব্যক্তিমালিকানা জমির পরিধি বৃদ্ধি করছেন। আবার কেউ জমি ক্রয় করে নদীর তীর পর্যন্ত বাধ দিয়ে বালু ভরাট করে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের স্থাপনা নির্মাণের কাজ করছে। স্থানীয় অধিকাংশ প্রভাবশালী সহ নদীতীরের সকল বাসিন্দারাও মাটি কেটে বাধ দিয়ে নদীর জমি ভরাট করে দখল করছেন।
নদীটির দু’তীরে ধীরে ধীরে ইটের টুকরো ফেলে ভরাট, ট্রলার মালিকদের নোঙ্গর করে রাখা অকোঁজো পুরানো ট্রলারের বডি, মৎস্য আড়ৎদার ব্যবসায়ীদের গদিতে মাছ ওঠানোর ও বরফকল মালিকদের বরফ নামানোর জেডি, এসকল জেডির পাড়ে নদীর তীরের নির্মিত রাস্তা, নদীর পাড়ে বাঁশ ব্যবসায়ীদের রাখা বাঁশ, নদীতে নির্মানাধীন শেখ রাসেল সেতুর স্প্যান ও অবৈধ দখলদারদের স্থাপনার জন্য স্রোত বাঁধা প্রাপ্ত হয়ে পলি জমে নদীটি দিন দিন ভরাট হয়ে যাচ্ছে। এছাড়াও দেশের অন্যতম মৎস্য বন্দর আলীপুর-মহিপুরের ব্যবহৃত অপচনশীল পলিথিন ও প্লাস্টিকের বর্জ্য নির্বিচারে ফেলা হচ্ছে নদীতে। যার ফলে পূর্ণ যৌবন হারিয়ে ফেলছে খাপড়াভাঙ্গা নদীটি।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ নদী পরিব্রাজক দল’র কুয়াকাটা শাখার সভাপতি নাসির উদ্দিন (বিপ্লব) বলেন, খাপড়াভাঙ্গা নদীটি একসময় ছিল খরস্রোতা। স্বাভাবিক নিয়মে জোয়ার ভাটায় পানি প্রবাহিত হতো। নদীর পরিধি ছিল প্রশস্ত। বর্ষাকালে মাঝেমধ্যে দেখা যেত বড় বড় ঢেউ। খরস্রোতা নদীর মাঝখানে নোঙ্গর করে থাকা নৌযান গুলো নিয়ে সেসবের নাবিকরা/জেলেরা হিমশিম খেতো। ছিল নদীটির নিজস্ব জৌলুস-দর্প এবং অনেক গল্প ইতিহাস। আজ তা কেবলই স্মৃতি!
আধুনিক জীবন যাত্রার চাকা সচল রাখতে নদীর বুকে নির্মিত হয়েছে সেতু। সেতুর স্প্যান এবং বিভিন্ন স্থানে নদীটি দখলের ফলে স্বাভাবিক পানি প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হওয়ায় ক্রমে ভরাট হয়ে আজ বার্ধক্যে উপনীত। এখনও এই নদীটির গুরুত্ব অপরিসীম। প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে নদীর দু’পারে মহিপুর আলিপুরে সাগর থেকে ধরে আনা মাছ বিক্রি এবং বরফ ও জ্বালানি সংগ্রহের জন্য কয়েক হাজার মাছধরা ট্রলার এই নদীর বুকে অবস্থান নেয়। এছাড়া দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় গভীর সমুদ্রগামী জেলেরা পোতাশ্রয় হিসেবে এই নদীকেই ব্যবহার করে। নানাভাবে অত্যাচার আর দখল-দূষণে আজ রীতিমত নদীটি অসহায়।
তিনি আরো বলেন, বলেন, ‘নদীর জমির ভরাট করে দু’পাড়ে অবৈধ দখলদাররা আধাপাকা-পাকা স্থাপনা নির্মাণ করেছে। মৎস্য বন্দরের সবধরণের অপচনশীর বর্জ্য নদীতে ফেলা হচ্ছে।
জানা যায়, তৎকালীন নৌ-পরিবহন মন্ত্রী শাহাজাহান খাঁন এই নদীটি খনন করার আশ্বাস দিয়েছিলেন। তবে কবে নাগাদ তা আলোর মুখ দেখবে তিনি তা নিশ্চিত করেননি। এরপর আর কেউ নেয়নি নদীটি খনন করার উদ্যোগ।
কলাপাড়া উপজেলা ফিসিং ট্রলার মাঝি সমবায় সমিতির সভাপতি মন্নান মাঝি জানান, তারা সাগরে থাকা অবস্থায় বন্যার সংকেত পেয়ে নদীটিতে নিরাপদে আশ্রয় নেয়। এটি মরে গেলে শত শত ট্রলার কোথায় আশ্রয় নিবে এমন প্রশ্ন তারও। বর্তমানে ভরাট হয়ে ছোট হওয়ার কারণে মোহনা থেকে প্রবেশ করার সময় ট্রলার নিমজ্জিত হওয়ার ভয় থাকে।
দিন দিন যৌবন হারিয়ে নদীটি এখন ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছে। কেন পোতাশ্রয় খ্যাত নদীটি মরে যাচ্ছে তার কারণ কেউ সনাক্ত করছে না। এমনকি খনন করা উদ্যোগও নিচ্ছে না সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে শুধু নদীর দু’পাড়ে গড়ে ওঠা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের স্থাপনা উচ্ছেদ করেই দায় শেষ। ফলে বার বার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। এরপরেও অদৃশ্য শক্তির জোরে বহাল তবিয়তে দাঁড়িয়ে আছে প্রভাবশালীদের অবৈধ স্থাপনা। উপকূলের মৎস্যজীবী জেলেরা গভীর সমুদ্রে মাছ শিকার করে ফিরে আসে নদীটিতে। দূর্যোগকালীন সময়ে গভীর সমুদ্রে মাছ ধরা জেলেদের নির্ভরযোগ্য আশ্রয় স্থল এ দোনটি। সমুদ্র ঝড় জলোচ্ছ্বাস শুরু হলে কয়েক হাজার মাছ ধরার ট্রলার এ নদীতে এসে নিরাপদে নোঙ্গর করে। তাই খাপড়াভাঙ্গা নদীটি উপকূলীয় অঞ্চল ছাড়াও দূর দূরান্তের জেলেদের কাছে পোতাশ্রয় নামে পরিচিত। নদীটির দু’পাড় থেকে প্রতি বছর হাজার কোটি টাকার মাছ দেশ-বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। এজন্যই আলীপুর-মহিপুর মৎস্য বন্দর হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছে। এ নদীটি পুরোপুরি মরে গেলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হবে দেশের বিভিন্ন এলাকার মৎস্যজীবী জেলেরা। বৈরী আবহাওয়ার সংকেত পেয়ে গভীর সমুদ্র থেকে জেলেরা নিরাপদে আশ্রয় নিতে পারবে না। এখানকার মৎস্য ব্যবসায়ীরা পড়বে বিপাকে। মৎস্য বন্দর আলীপুর, মহিপুর, কুয়াকাটার অন্যান্য ব্যবসায়ীরা পারবে না নৌপথে খুলনা, ঝালকাঠি, বরগুনা, বরিশাল থেকে মালামাল আনতে।
এবিষয়ে মৎসজীবী জেলেরা বলেন, ‘আমরা গভীর সমুদ্রে ফিশিং করি। বৈরী আবহাওয়ার সংকেত পেয়ে দ্রুত এ নদীতে নিরাপদ আশ্রয় নিতে পারি। কিন্তু বর্তমানে ভাটার সময় প্রবেশ করতে পারছি না। জোয়ারের অপেক্ষায় ঝুকি নিয়ে সমুদ্র মোহনায় থাকতে হয়।
আরেক জেলে জানান, হাজার হাজার গভীর সমুদ্রগামী ট্রলারের নিরাপদ আশ্রায়ের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে দ্রুত খনন করতে হবে। অন্যথায় চলতি বছরের বর্ষা মৌসুমে ঝড় জলোচ্ছ্বাস শুরু হলে নদীতে কোন ট্রলার প্রবেশ করতে পারবে না। গত বর্ষা মৌসুমে গভীর সমুদ্র থেকে ফিরে মোহনায় তাদের একটি ট্রলার নিমজ্জিত হয়েছিলো।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)’র কলাপাড়া উপজেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক মেজবাহ উদ্দিন মাননু বলেন, ‘আমরা দীর্ঘ বছর পর্যন্ত খাপড়াভাঙ্গা ও আন্ধারমানিক নদীসহ এ অঞ্চলের বিভিন্ন নদী দখল, দূষণ ও ভরাটের কবল থেকে রক্ষার দাবিতে সামাজিক আন্দোলন করছি। নদী রক্ষা কমিটির সভায় একাধিকবার বলা হয়েছে, অবৈধ দখলদারদের তালিকা হালনাগাদ করে এদের উচ্ছেদ করে নদী দখল মুক্ত করা হউক। নদীর সাথে জলকপাট, খালও আমরা দখল মুক্ত দাবী করে আসছি। কিন্তু এর কোন অগ্রগতি আমার দেখতে পারছি না। এর জন্য আমরা হতাশা এবং বিস্ময় প্রকাশ করছি।
এবিষয়ে কলাপাড়া উপজেলা (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী খালেদ বিন ওয়ালিদ বলেন, সারা বাংলাদেশে খাল খনন প্রকল্প প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। সেই প্রকল্পে খাপড়াভাঙ্গা নদীটি খননের জন্য প্রস্তাবনা দেয়া আছে। অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সরেজমিনে তালিকা প্রস্তুত করে উচ্ছেদ করা হবে।
মন্তব্য করুন