পটুয়াখালীর কুয়াকাটা পর্যটন নগরীর একমাত্র  খালটি বর্তমানে প্লাস্টিক ও পলিথিনের ভাগাড়ে পরিনত হয়েছে। কতৃপক্ষের উদাসীনতায় এটি মৃতপ্রায়! খালের দুইপাশে গড়ে তোলা হয়েছে অর্ধশতাধিক অবৈধ স্থাপনা, মানুষের স্বাভাবিক জীবনমান বিপাকে রয়েছে।

২৬ কিলোমিটার দৈর্ঘ ও ২০০ ফুট প্রস্থ বিশিষ্ট ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন দুইশো বছর পূর্বের ঘাটলার খালটিতে একসময় চলাচল করতো বিভিন্ন নৌযান। তখনকার সময়ে এটিই ছিলো যাতায়েতের একমাত্র মাধ্যম। বর্তমান এ খালটির অতীতে নদীর যৌবনারূপ বিদ্যমান থাকলেও সম্প্রতি যেনো খালেও স্বীকৃতি পাচ্ছেনা! স্থানীয়রা অভিযোগ করেন দ্রুত সময়ের মধ্যে খালটিকে রক্ষা করা না হলে কুয়াকাটা হবে জলাবদ্ধ নগরী। এবং কুয়াকাটা পৌরসভা এলাকার নাগরিক সেবা থেকে বঞ্চিত কয়েক হাজার বাসিন্দারা। খালটির অব্যাবস্থাপনায় অত্র এলাকার কৃষি কাজে সম্প্রসারনের প্রধান বাধা সহ পানি প্রবেশ; বর্জ্য-পয়োনিষ্কাশন ব্যাবস্থা  না থাকায় পঁচা দুর্গন্ধে অতিষ্ঠ, মশা মাছির উদগ্রীবে স্থানীয় জনসাধারন ও পর্যটকরা ভোগান্তির চরমে রয়েছে। পৌরসভা এলাকা ও পার্শবর্তী ইউনিয়নের কৃষি নির্ভর পানির চাহিদা পূরনে এই খালটিই একমাত্র মাধ্যম।

সরেজমিনে দেখা গেছে, বর্ষা মৌসুমের শুরু থেকে মাত্র কয়েকমাস খালের সামান্য পানি প্রবাহের স্বরূপে থাকলেও বাকী দীর্ঘমাসজুরে পানিশূন্য থাকে অত্র অঞ্চলের জীবনব্যাবস্থা!

তবে কার্যকরী পদক্ষেপের মাধ্যমে খালটিতে পূর্বের ন্যায়ে যেমন নৌযান চলাচলের উপযোগীও করা হচ্ছে না, অন্যদিকে অপরিকল্পিতভাবে উন্নয়ন অবখাঠামোয় তুলনামূলক ছোটো কালভার্ট নির্মাণ করে অতীতের প্রবহমান গতিপথ আটকে ফেলা হচ্ছে। ফলে পানি নিস্কাশনের স্বাভাবিক প্রবাহ বন্ধ হয়ে বিভিন্ন প্লাস্টিকের বর্জ্য, পলিথিন সহ ময়লা আবর্জনার ভাগাড়ে পরিনত হয়েছে কুয়াকাটার একমাত্র এই খালটিতে।

 

এছাড়াও খালটিতে স্থানীয় প্রভাবশালী দখলদারদের কবল থেকে সম্রতি পুনরুদ্ধার করে স্বরূপে ফিড়িয়ে আনা হলেও পৌরসভার মধ্যে কয়েকটি চক্র দখলের পায়তারায় বাঁধ প্রক্রিয়ায় ভিন্ন ভিন্ন কৌশল আবলম্বন করে পর্যটন নগরী ও পৌরসভা এলাকার মারাত্বক জনদূর্ভোগ তৈরী করেছে। যার প্রভাবে খালের মধ্যে কাঁদা-মাটির স্থিতিশীলতায় ভড়াট হয়ে গেছে দীর্ঘ ২৬ কিলোমিটার। আবার কেউকেউ খালের এই ভড়াট দেখিয়ে পায়তারা করছে খালটিকে গলাটিপে মেরে ফেলার! যা  উপকূল অঞ্চলের জন্য পরিবেশের ভারসাম্য বিপর্যয়ের অন্যতম চিহ্নিত একটি পথ।

কোন কোন স্থানে দখলদারদের বাঁধের কবলে খালের বিভিন্ন অংশে পানি এপাশ-ওপাশও হচ্ছে না! যে কারণে পৌর এলাকা সহ উপকূলের অধিকাংশ খালের পানির স্বাভাবিক গতিপ্রবাহ ও বর্জ্য নিষ্কাশন ব্যবস্থা স্থবির হয়ে দাড়িয়েছে।  দ্রুত এই ভোগান্তি থেকে রেহাই পেতে সরকারের নিকটে দাবি জানিয়েছেন উপকূলীয় অঞ্চলের কয়েক হাজার স্থানীয় বাসিন্দারা।

স্থানীয়রা অভিযোগ করেন যে, জোয়ারের স্বাভাবিক পানি ওঠানামা করতে না পারার ফলে এই অবনতি-পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। যদি জোয়ারের স্বাভাবিক পানি ওঠানামা করতে না পারে তাহলে অচিরেই লতাচাপলী ও কুয়াকাটা পৌরসভার একমাত্র খালটি ময়লা আবর্জনার স্তূপে  নালায় পরিনত হবে এবং নব্যতা হারাবে যা আমাদের স্বাভাবিক জীবনমান, পরিবেশ প্রতিবেশ বিনষ্ট সহ নানান সঙ্কটে রূপ নিবে! আর এর দায় জনপ্রতিনিধি সহ প্রশাসনকেই নিতে হবে বলে এমন মন্তব্য করেন তারা।
তারা আরো বলেন, কুয়াকাটা পৌরসভা ও লতাচাপলীর মধ্যে দৃষ্টিনন্দিত এমন একটি খাল থাকার পড়েও যেটিকে কুয়াকাটায় পর্যটন খাতে দেশের অর্থনৈতিক প্রসারে এখনো কোন কাজে লাগাতে পারেনি পর্যটন সংশ্লিষ্টরা। বিষয়টি আসলেই দুঃখজনক বলেও অভিহিত করেন তারা। তারা আক্ষেপ প্রকাশ করে বলেন, যদি একমাত্র খালটিতে নির্দিষ্ট সীমানা নির্ধারণের মাধ্যমে নির্মাণাধীন কালভার্টগুলোকে ব্রিজে রূপান্তর করা হতো তাহলে খালের মধ্যে ছোটো নৌযান চলাচল সহ পর্যটকদের বিনোদনের অন্যতম কেন্দ্রস্থলে পরিনত হত। এটি পর্যটন কেন্দ্রের সৌন্দর্য বর্ধনে সহায়ক হত। কিন্তু কতৃপক্ষের উদাসীনতায় খাল দখলের পায়তারা করে একেরপর এক জটলা সৃষ্টি করছে স্থানীয় কয়েকটি দখলদার চক্র।
স্থানীয় পর্যটন সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করে বলেন, খালের মধ্যে যত্রতত্র কালভার্ট নির্মাণ করার ফলে কুয়াকাটা পর্যটন নগরীতে পর্যটকদের বিনোদনের এবং নগরবাসী, উপকূলের মানুষের ব্যাবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে।
ঐদিকে কুয়াকাটার পূর্বে খালের দুইপাশে ইউনিয়নের অভ্যন্তরে প্রায় অর্ধশত বাঁধ দেয়া রয়েছে; খালের এপার থেকে ওপারে শতশত এটন জাল বছরজুরে ফেলে রাখায়  সামান্য ময়লা আবর্জনাও কোনোদিকেই সরে যেতে পারছে না বিধেয় কাদামাটির সাথে পলি জমা হয়ে চর পরে ভড়াট গেছে! যার প্রশাসনিক কোনো তৎপরতা না থাকায় প্রকটরূপে এর প্রভাব বিস্তার হচ্ছে কুয়াকাটা সহ পার্শবর্তী ইউনিয়নের প্রবহমান খালের পরিবেশ প্রতিকূলতায়।

কিন্তু কুয়াকাটায় খালের পানি দূষনে এবং ময়লা আবর্জনার ভাগাড়ে পরিনত হওয়ার পেছনে একমাত্র কারন হিসেবে দেখা গেছে যে, পৌরসভা কার্যালয়ের সামনে কুয়াকাটা মাছের আড়ত সহ সবজি-কাঁচা বাজার স্থাপনা করা হয়েছে। যা বাজার স্থাপনের বড় অংশে অতীতে খালের মধ্যে বেশ কিছু সীমানা অংশ জড়িত আছে! মাছের বাজার সংলগ্ন খালের উপরে পূর্বের একটি ব্রিজ ছিলো এখনো তা অপসারন করা হয়নি; যার ফলে পাশাপাশি দুটি ব্রিজের মধ্যস্থ মাটি ভড়াট সহ মাছ বাজারের সকল ময়লা-বর্জ্য ফেলানোর জন্য পানি চলাচলের বাঁধাই এখন মুখ্য।

ঐদিকে খাল ভড়াট হয়ে যাওয়ার ফলপ্রুসু নদীর সাথে সংযুক্ত স্লুইস গেট আটকে সামান্য কয়েকমাস পানি ধরে রাখা হলেও তাও কোনো কাজে আসছে না এবং এতে কৃষি নির্ভর অঞ্চল পোউরসভা-ইউনিয়নের বাসিন্দা সহ পর্যটকদের সেবাদানে আরো বেশি ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে বলে মন্তব্য এলাকাবাসীর।
কুয়াকাটা পর্যটন নগরীর ও একটি গুরুত্বপূর্ণ পৌরসভায় নাগরিক ও পর্যটক সেবা দানে একযুগে মোট ৯টি ওয়ার্ডের মধ্যে মাত্র কয়েকটি ড্রেনেজ ব্যবস্থা করা হলেও এখন পর্যন্ত সবগুলো সচল করা যায়নি। ফলে পৌর এলাকার বাসিন্দাদের ময়লা পানিসহ বর্জ্য নিষ্কাশন ব্যবস্থাপনায় বাঁধা হয়ে দাড়িয়েছে; এতে নানারকম ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন পৌর বাসিন্দারা। খালের অভ্যন্তরে প্রভাবশালীদের বেশ কয়েকটি জায়গায় রয়েছে বাঁধ দেয়া যার ফলে পানি নিষ্কাশন হচ্ছে না এমন অভিযোগও উঠেছে।
সম্প্রতি বছর পূর্বে একমাত্র সরকারি খালটি খনন করা হলেও তা পূর্বের তুলনায় ক্ষতির দিকটি সামনে আসে বলে মন্তব্য করেন এলাকাবাসী।এ বিষয়ে পৌরসভার ৬ নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা রফিকুজ্জামান, দুলাল ফকির সহ অনেকেই বলেন, পৌর এলাকার যেসব বাসা বাড়ি, হোটেল-রিসোর্ট থেকে ময়লা পানি ও আবর্জনা খালের মধ্যে পতিত হচ্ছে সে সকল পদার্থ থেকে রীতিমত দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে, মশা মাছির উপদ্রবে হিমশিম খেতে হচ্ছে যা বাসযোগ্যের অনুপযোগী নগরী হিসেবে বিবেচ্য। খালটিকে দ্রুত ময়লা পানি ও বর্জ্য নিষ্কাশনের উপযোগী করার জন্য সংশ্লিষ্টদের প্রতি জোর দাবি জানাই। ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন ঘাটলার খালটিতে পূর্বের রূপে ফিড়িয়ে আনতে সরকার কার্যকরী পদক্ষেপ নিবে এমনটিই প্রত্যাশা আমাদের সকলের।লতাচাপলি ইউপি চেয়ারম্যান মোঃ আনসার উদ্দিন মোল্লা জানান, পর্যটন নগরীর বিশেষ আকর্ষণ হিসেবে এবিষয়ে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হবে যাতে সমগ্র পর্যটন নগরীর সৌন্দর্য বর্ধনের মনোরম পরিবেশে পর্যটকদের ভ্রমনে আকৃষ্ট করে এবং ভ্রমণ পিপাসা মেটায়। তিনি আরো জানান পর্যটন শিল্পের সম্ভাবনার দ্বার লতাচাপলীর একমাত্র খালটিতে লেক রূপান্তর করণে বিশেষ পরিকল্পনা রয়েছে আমাদের। এবিষয়ে সরকারের সহযোগিতা পেলে আমরা দ্রুত পর্যটন শিল্প প্রসারিত করতে আমাদের পর্যটন কেন্দ্রের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারতাম। তাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি বিশেষ কৃতজ্ঞতা যিনি পর্যটনশিল্পের সম্ভাবনা উপকূল কুয়াকাটাকে দিয়েছেন। আমরা চাই তিনি কুয়াকাটা সহ উপকূল অঞ্চলের দিকে বিশেষ লক্ষ্য রাখেন যাতে পর্যটন শিল্পের সম্ভাবনা টিকে থাকে।

কুয়াকাটা পৌর মেয়র আনোয়ার হাওলাদার জানান, জেলা প্রশাসকের সাথে সমন্বয় করে খাল দখলমুক্ত করা হবে। এরপর খাল খনন করে পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে দৃষ্টিনন্দন লেক তৈরি করার পরিকল্পনা রয়েছে। তবে খালের দুইপাশে অধিকাংশ বসতির দখলে চলে গেছে। বর্তমানে ড্রেন স্পেস করার জন্য পৌরসভার আওতাধীন একটি প্রকল্প অনুমোদন হয়েছে পর্যটন নগরীর সৌন্দর্য বর্ধনের লক্ষ্যে যার সার্ভে করা হয়ে গেছে এবং ডিজাইনের কাজ চলমানাধীন রয়েছে।

কুয়াকাটার খালটিকে পরিচ্ছন্ন ও দখলমুক্ত করতে যৌথভাবে কাজ করার আহ্ববান জানিয়েছেন কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর হোসেন।

-আরএইচবি/কে.বি/১৬.০৪.২০২৩