পটুয়াখালীর মৎস্য বন্দর আলীপুর-মহিপুরে ভড়া মৌসুমে ইলিশের দেখা নেই। সমুদ্রগামী জেলেদের জালে ধরা পড়ছে না কাঙ্ক্ষিত ইলিশ। এবছর ঘন ঘন বৈরী আবহাওয়ার কবলে পড়ে মৌসুমের অধিকাংশ সময়ই ঘাটে বসে কর্মহীন সময় কেটেছে জেলেদের। আবহাওয়া অনূকুলে আসার পর পরই সমুদ্রে গিয়ে জাল ফেলেও ইলিশ পাচ্ছে না; ফিরতে হচ্ছে অন্যান্য মাছ নিয়ে। অন্যান্য মাছের দেখা মিললেও সমুদ্র যাত্রার খরচ উঠাতে পারছেনা অধিকাংশ জেলেরা। অভাব অনটন আর দুশ্চিন্তায় সময় কাটাচ্ছেন জেলেরা। মাঝেমধ্যে কিছু ট্রলারে ইলিশের সরবারহ বাড়লেও তার দাম চড়া হওয়ায় মধ্যবিত্তদের তা আর ক্রয় ক্ষমতার নাগালে থাকছেনা।

পটুয়াখালীর মৎস্য বন্দর ও উপকূলের বিভিন্ন আড়ৎ ঘাট ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত উপকূলীয় ও গভীর সমুদ্রের জেলেরা মাছ শিকার করতে যাওয়া-আসা করছেন। সমুদ্র থেকে আসা ট্রলারে যে পরিমান মাছ নিয়ে আসছে, তা দিয়ে মাছ শিকারে গিয়ে খরচের মূলধন তুলতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে। অনেকেই আবার খরচের টাকাই তুলতে পারছে না বলে জেলেদের সাথে কথা বলে এমনটাই জানা গেছে। তবে কিছু জেলেদের জালে মাঝে মধ্যে কাঙ্ক্ষিত মাছ পেলেও তা অতি নগণ্য।

দেশের সর্বদক্ষিনের উপকূল অঞ্চল সুবাধে অধিকাংশ বাসিন্দারা জড়িত জেলে পেশার সাথে। কলাপাড়া উপজেলায় ১৯ হাজার নিবন্ধিত জেলে। হিসাব অনুযায়ী জেলায় মোট ৭৯ হাজার নিবন্ধিত জেলে রয়েছে। এর বাইরেও মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করেন এখানকার লক্ষাধিক জেলে। তবে গত কয়েক বছরের দিকে লক্ষ্য করলে জানা যায়, অভাব অনটন আর ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ে অনেকেই জেলে পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় ঝুঁকেছেন। কেউ আবার ইলিশের বিকল্প হিসেবে জীবিকার তাগিদে অন্যান্য মাছ ধরতে বৈধ-অবৈধভাবে উপকরন এবং পদ্ধতি পরিবর্তন করেছে।

স্থানীয় জেলেরা জানায়, বৃষ্টিপাত হলে সমুদ্রে মাছ বাড়ে। কিন্তু সম্প্রতি টানা বৃষ্টিপাত হলেও মিলছে না কাঙ্ক্ষিত মাছ। উপকূলের নদ-নদীতেও জেলেদের জালে মিলছেনা ইলিশ মাছ। এ সময় জেলেদের জালে ইলিশ ধরা পড়ার কথা। তবুও জেলেদের জালে মিলছে না ইলিশ। একাধিক জেলের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ইলিশের মৌসুম শুরু হওয়ার পর থেকে তারা দিনরাত নিয়মিত জাল ফেলছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য ইলিশ না পেয়ে তাদের অনেককেই খালি হাতে ঘাটে ফিরতে হয়েছে।

জেলে আলমগীর হোসেন জানান, জ্যৈষ্ঠ থেকে আশ্বিন, এখন ভাদ্র পেরিয়েও ইলিশের ভরা মৌসুম। সমুদ্রে হন্য হয়ে ঘুরেও মাছের দেখা পাচ্ছেন না। যে মাছ পাচ্ছেন তা দিয়ে খরচের টাকাই উঠছেনা। হানিফ নামে আরেকজন জেলে বলেন, উপকূলের ডুবোচর ও নাব্যতা সংকটের কারণে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।

উপকূলবর্তী খুটা জেলে মোঃ জালাল হাওলাদার জানান, বিগত ২০ বছর যাবৎ আমরা ইলিশ মাছ ধরে আসছি। উপকূলবর্তী এখন আর ইলিশ পাচ্ছি না। আমাদের এখন গভীর সমুদ্রে গিয়ে জাল ফেলতে হয়। তবে তা দিয়ে আমাদের পোষাচ্ছে না। তাই বাধ্য হয়ে আমরা অন্যান্য মাছ ধরার জন্য উপকর পরিবর্তন করেছি। ইলিশের আশা ছেড়ে দিয়েছি। আমাদের এই জেলে পেশা ছাড়া আর বিকল্প নেই। মহাজনের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা দাদন এনেছি। পরিশোধ করা ছাড়া চাইলেও এই পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় যেতে পারছিনা।

স্থানীয় মাছ ব্যবসায়ী হালিম জানান, এখানকার স্থানীয় বাজারে প্রতি কেজি আকারভেদে বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৬০০ থেকে ২ হাজার ৩০০ টাকায়, ছোট ইলিশ ৭০০ থেকে ১ হাজার টাকা।

আলীপুর মৎস্য বন্দর ট্রলার ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সভাপতি ও মেসার্স মনি ফিশের ব্যবস্থাপক মো. জলিলুর রহমান বলেন, প্রতিবছর দেখতে পাচ্ছি ইলিশের সরবারহ কমে আসছে। আমাদের ব্যবসায়ীদের এতে তেমন ক্ষতি না হলেও জেলেরা মূলত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। তবে সমুদ্রে ইলিশ কম পাওয়ার কারন হিসেবে এই ব্যবসায়ী উল্লেখ করে বলেন, মা ইলিশের ইলিশের সুষ্ঠ প্রজন সময়কালে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ও মিয়ানমারের জেলেরা আমাদের জলসীমায় প্রবেশ করে মাছ ধরে নিয়ে যাওয়ার ফলে আমাদের দেশীয় জেলেরা মাছ পাচ্ছেনা। এবিষয়ে প্রশাসনের আরো কঠোর হতে হবে। না হলে একসময় ইলিশের উৎপাদন একদম কমে যাবে।

পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের অ্যাকুয়াকালচার বিভাগের চেয়ারম্যান লোকমান আলী বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সাগরে ডুবোচর জেগেছে। নদ- নদীর পানি হ্রাস পাচ্ছে। বিশেষ করে প্রজননের সময় মিঠা পানিতে চলে আসে ইলিশ মাছ। কিন্তু ডুবোচরের পাশাপাশি বিভিন্ন পদার্থের কারণে দিন দিন নদীর পানিও দুষিত হচ্ছে। প্রজননের সময় মা ইলিশ উপকূল সহ নদ-নদীতে আসতে না পাড়ায় দিন দিন ইলিশের সংখ্যা কমছে।

কলাপাড়া উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা অপু সাহা জানান, ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা শেষে আশা করা হচ্ছিল জেলেদের জালে প্রচুর ইলিশ ধরা পরবে। কিন্তু অধিকাংশ জেলেদের ফিরতে হচ্ছে অন্যান্য মাছ নিয়ে। মৌসুমের শেষের দিকেও ইলিশের আকাল যেন কাটছেই না৷ আবার যে পরিমান ইলিশ ঘাটে আসছে তা বিক্রি হচ্ছে চড়া দরে। এর কারন হিসেবে ইলিশের সরবারহ কম থাকাকেই দ্বায়ী করছেন এই মৎস্য কর্মকর্তা।