কুয়াকাটায় বনের উপড়েপড়া গাছ উজারে..

প্রকাশ: ৩ জুন ২০২৪ । ১৯:৪২ | আপডেট: ৩ জুন ২০২৪ । ১৯:৪২

আব্দুল কাইয়ুম আরজু কুয়াকাটা করেসপন্ডেন্ট:-

ঘুর্ণিঝড় রেমাল তান্ডবে পটুয়াখালীর কুয়াকাটা সমুদ্র উপকূলের হাজারো গাছ উপড়ে গিয়ে ধ্বংস হয়ে গেছে। বিলীন হয়েছে শত শত একর বনভূমি। সমুদ্রোপকূলের দেয়াল খ্যাত হিসেবে সবুজ বেষ্টনি ঘুর্ণিঝড় রেমালে ভগ্নদশায় পরিনত হয়েছে। ঘূর্ণিঝর সিড়র পরবরতী এমন ধ্বংস যজ্ঞ আর কোনো দূর্যোগেই দেখেনি কুয়াকাটা উপকূলবাসী।

তবে ঘূর্ণিঝড়ে তিব্র বাতাসের তান্ডবে উপরে ও ভেঙ্গে যাওয়া গাছ স্থানীয় শতাধিক মানুষ কেটে নিলেও এসব গাছ রক্ষায় কার্যকরী কোনো পদক্ষেপ নেই বন বিভাগের। এছাড়া বন কর্মকর্তাদের অবহেলার কারণে ঝড়-বণ্যা ছাড়াও প্রতিনিয়ত বনদস্যুদের কবলে উজার হচ্ছে বনাঞ্চল এমন অভিযোগ স্থানীয় বাসিন্দাদের।

বনবিভাগের তথ্যমতে রেমালে বন বিভাগ পটুয়াখালীর মহিপুর রেঞ্জের বনভূমিতে প্রায় এক কোটি বিশ লাখ টাকার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে কুয়াকাটা উপকূল অঞ্চলের যে ক্ষতি হয়েছে তা কোন অর্থ দিয়ে পূরণ করা সম্ভব নয় বলে পরিবেশ কর্মীদের অভিমত।

অপরদিকে ঘুর্ণিঝড় রেমাল পরবর্তী সময় দেখা গেছে কুয়াকাটা জাতীয় উদ্যান খ্যাত ঝাউবাগানসহ কুয়াকাটা সংরক্ষিত বনের ক্ষতিগ্রস্ত অসংখ্য উপড়ে যাওয়া গাছ প্রকাশ্যে কেটে নিয়ে যাচ্ছে উপকূলের মানুষ। পাশাপাশি জীবন্ত গাছ কেটে নিয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন সময়ে। সমুদ্র তীরবর্তী মানুষদের জন্য বনের যে গাছ তাদের ঢাল হিসেবে কাজ করছে সেই উপকূলের মানুষরাই বন ধ্বংসে লিপ্ত রয়েছেন। অভিযোগ রয়েছে বন উজাড়ে সহযোগিতা করছেন বন কর্মীরাই।

আরো অভিযোগ রয়েছে, প্রাকৃতিক দূর্যোগ এবং সমুদ্রের ঢেউয়ের জাপটায় ভূমি ক্ষয়ে জাতীয় উদ্যানের ফলকসহ বিভিন্ন স্থাপণা ভেঙ্গে যাবার পাশাপাশি সড়কের ইট বেড়িয়ে আসে। এসব ইট বিক্রি করে দিয়েছেন কুয়াকাটা বিট কর্মকর্তা। এছাড়া বনের গাছ, উদ্যানের সড়কের এসব ইট স্থানীয়দের কাছে নামমাত্র মুল্যে বিক্রি করে দিচ্ছেন বলে স্থানীয় বাসিন্দারা জানান।

ঘূর্ণিঝড় সিডর পরবর্তী বেশ কয়েকটি ঝড়-বন্যা জ্বলোচ্ছাসের কবলে পড়ে বিশাল এই বনভূমি। গত ২০ বছরে কুয়াকাটা সমুদ্র উপকূলের কয়েক’শো কোটি টাকার বন উজাড় হয়ে গেছে। পাশাপাশি উপকূল ভাগ কমে গিয়ে বন্যা নিয়ন্ত্রন বেঁড়িবাধ সংলগ্ন বসতির কাছাকাছি চলে এসেছে সমুদ্র। উপকূলের কিছু স্থানে বেঁড়িবাধের উপড়ে আছড়ে পড়ছে সমুদ্রের বড়বড় ঢেউ।

কুয়াকাটা রিজার্ভ ফরেস্ট ক্যাম্প সুত্রে জানাগেছে, ঘুর্ণিঝড় রেমালে কুয়াকাটা সংরক্ষিত বনের প্রায় আড়াই শতাধিক গাছ উপড়ে ও ভেঙ্গে গিয়েছে। এছাড়া মহিপুর রেঞ্জের আওতায় সংরক্ষিত বন, সবুজ বেষ্টনীটির প্রায় দুই হাজার গাছ ধ্বংস হয়ে গেছে। প্রতি বর্ষা মৌসুমেই সমুদ্রোপকূলের ১০০ একর বনভূমি সমুদ্র গর্ভে বিলীন হচ্ছে।

তবে সরকার বন রক্ষায় নানামুখী উদ্যোগের কথা বললেও বাস্তবতার নজির নেই। বন সৃজনের চেয়ে প্রতিবছর বন ধ্বংসের পরিমানই বেশি। জলবায়ুর প্রভাব থেকে রক্ষায় যেখানে নেয়া হচ্ছে নানা পদক্ষেপ, সেখানে সংরক্ষিত বন রক্ষায় বন বিভাগের নেই কোনো ভূমিকা।

সরেজমিনে ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী এক স্পর্শকাতর দৃশ্য দেখা গেছে জাতীয় উদ্যানের কুয়াকাটা বিট এলাকায়। ঝড় পরবর্তী বনে উপড়ে ও ভেঙ্গে পড়া গাছগুলোকে প্রথমে একদল গাছের ডালপালা, কেউ গাছের মাথার অংশ, আরেকদল গাছের অর্ধেক, কেউ আবার পুরো গাছের গোড়া থেকে কেটে নিয়ে যাচ্ছে। এমন কর্মকান্ডে অত্র এলাকার অনেকেই হতবাক হয়ে পড়েন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় অনেক বাসিন্দার জানান, যারা গাছ নিচ্ছে এরা অধিকাংশ সমুদ্র সংলগ্ন স্থানীয় বাসিন্দা। এরা প্রভাবশালী হওয়ায় কেউ ভয়ে মুখ খুলতে পারছে না।

তারা বর্তমান স্থানীয় জনপ্রতিনিধির প্রভাব খাটিয়ে শুধু গাছই নয়, কুয়াকাটা জাতীয় উদ্যানের সাইনবোর্ড, সড়কের ইট সহ ধ্বসে পড়া নানা স্থাপনার ভেঙ্গে নিয়ে যাচ্ছে রডও। ঘূর্ণিঝড় রেমাল পরবর্তী সড়কের যেসকল ইট নেওয়া হচ্ছে এতে মহিপুর রেঞ্জ কর্মকর্তা সহ কুয়াকাটা বিট কর্মকর্তাও জরিত রয়েছে বলে তাদের দাবী।

স্থানীয় এই প্রভাবশালী চক্রটি গত বছরও বন বিভাগের অসাধু কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে বনের গাছ, ইট নিয়ে গেছে। স্থানীয়দের অভিযোগ চলতি বছরে কয়েক লাখ টাকার গাছ ও ইট সরিয়েছে এই চক্রটি।

স্থানীয় বাসিন্দা মোসাঃ ফুলবানু আরএইচবি নিউজ কে জানান, বনের পাশে বসবাসরত প্রভাবশালীরা রাতের আধারে গাছ কেটে নিয়ে যায়। এসব গাছ নিয়ে বিক্রি, ঘর তোলা, ঘরের আসবাবপত্র সহ জ্বালানির কাজে ব্যবহার করে থাকেন। একই কথা জানান মোসাঃ চিনিমতি। তিনি বলেন, গাছ কেটে নিলেও বন বিভাগের কর্মকর্তারা দেখেও দেখেনা।

বনের উপকারভোগিরা জানান, এসব গাছগুলো না থাকলে আমাদের অত্র এলাকার বাসিন্দাদের টিকে থাকা সম্ভব ছিল না। এই গাছগুলোর কারনে আমরা ঝড়-বন্যা থেকে কিছুটা রেহাই পাচ্ছি। নয়তো মরা লাগতো সাগরের পানিতে ভেসে। তাদের অভিযোগ, বনের যেসকল গাছ উপড়ে যাচ্ছে সেসবের অধিকাংশ গাছ প্রভাবশালী একটি চক্র রাতের আধারে এবং প্রকাশ্যে দিবালোকে কেটে নিয়ে গেলেও তাদের দাপটে কোনো কথা বলা যায়না।

এদের মধ্যে বশারসহ কয়েকজনের নাম উল্লেখ করে তারা জানান, এই চক্রটি কুয়াকাটা ঝাউবন এলাকায় বর্তমান মেয়রের নাম ভাঙ্গিয়ে বনের গাছ, সড়কের ইটসহ বন ধ্বংসে লিপ্ত রয়েছে। এদের পেশা বন উজাড় করে জীবিকা নির্বাহ করা। স্থানীয়দের প্রশ্ন প্রতিবছর ঝড় বন্যায় শত শত গাছ উপড়ে পড়লেও এসব গাছের কোন হদিস নেই কেন? টেন্ডারের মাধ্যমে বিক্রিও করা হয়নি। তাহলে এসব গাছ যায় কোথায়? তাদের দাবী বন কর্মকার্তাদের দায়িত্বশীল ভূমিকাই পারে এই বন রক্ষা করতে।

বন সংলগ্ন বাসিন্দা মোঃ সিদ্দিক খাঁ আরএইচবি নিউজ কে জানান, বনে পড়ে থাকা গাছগুলোকে ভিলেইজারদের মাধ্যমে কিছুদিন পরপর বিট কার্যালয় নিয়ে যায় কর্মকর্তারা। বিট কার্যালয় বসে প্রতিদিন এসব গাছ বিক্রি না করলে যায় কোথায় এসব? তবে অধিকাংশ জীবন্ত গাছগুলোকে সমুদ্রগামী ট্রলি বোট এবং অবৈধভাবে ভূলা চিংড়ি শিকারী জেলেরা কেটে নিয়ে যায়। এছাড়া স্থানীয় অধিকাংশ খুটা জেলেরা বোটের নিচে মোটা গাছের অংশ কেটে ব্যবহার করে থাকেন বনের এসব গাছ দিয়েই।

স্থানীয় বাসিন্দা নাজমুল ইসলাম বলেন, আমরা জানি যে কুয়াকাটা বিট এড়িয়ায় দীর্ঘ বছর ধরে বনে পড়ে থাকা গাছের কোনো অকশন দেয়া হয়নি। কিন্তু এই শত শত গাছ বছর ঘুরতেই যাচ্ছে কোথায় বা কারা নিচ্ছে?

অন্যদিকে বেলাল মাঝিসহ একাধিক বাসিন্দারা অভিযোগ করে বলেন, মহিপুরের পনু নামের এক প্রভাবশালী ব্যক্তির সাথে মহিপুর রেঞ্জ কর্মকর্তা আবুল কালাম এর সখ্যতায় বছরের পর বছর বনের গাছ বিক্রির নজির রয়েছে। এবং কুয়াকাটা পৌরসভা ও লতাচাপলী ইউনিয়নের কয়েকটি চক্রের সাথেও রয়েছে এর সখ্যতা।

এবিষয়ে কুয়াকাটা বিট কর্মকর্তা মোঃ সিরাজুল ইসলাম হক বনের গাছ বিক্রির কথা অস্বীকার করে বলেন, বনের গাছ কাটার জন্য বনদস্যুদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে। আদালত বনদস্যুদের বিরুদ্ধে কোন আইনী পদক্ষেপ নিচ্ছে না।

তিনি আরো জানান, দ্বায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বনদস্যুদের সাথে একাধিকবার ধস্তাধস্তি হয়েছে। আমি এখানে আসার পর থেকে গত দুই বছরে এখন পর্যন্ত ১২টি মামলা দায়ের করা হলেও আদালত কোনো ব্যবস্থা না নিলে আমাদের আর কি করার আছে। রেমাল পরবর্তী বনদস্যুদের বিরুদ্ধে এনিয়ে আরো একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে।

তবে টেন্ডার ব্যাতিত উদ্যানের ইট বিক্রির বিষয় তিনি জানান, ইট গুলো বালুর নিচে ঢুকে যাচ্ছে, এছাড়া ঢেউয়ের জাপটায় সমুদ্র গর্ভে চলে যাচ্ছে, অন্যদিকে স্থানীয়রা যাতে নিতে না পারে এজন্য সড়িয়ে স্থানীয়দের জিম্বায় রাখা হচ্ছে। পরে টেন্ডার দেয়া হবে। তবে জনবল সংকটে বন রক্ষায় কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হচ্ছেন বলে জানান এই বিট কর্মকর্তা।

মহিপুর রেঞ্জ কর্মকর্তা আবুল কালাম বনের গাছ বিক্রির সাথে নিজেদের জরিত থাকার কথা অস্বীকার করে বলেন, বনদস্যুরা উল্টো তাদের বিরুদ্ধে মামলা হামলার ভয় দেখান। প্রশাসনিক সহযোগিতা সঠিক সময়ে পাচ্ছেন না এমন দাবী এই বন কর্মকর্তার।

তিনি আরো বলেন, ঘুর্ণিঝড় রেমালে মহিপুর রেঞ্জের আওতায় থাকা বনাঞ্চলের শত শত গাছ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে আনুমানিক ১ কোটি বিশ লাখ টাকার লোকসান হয়েছে। গত দুই বছরে কয়েক হাজার গাছ ঝড়ে ধ্বংস হয়েছে। এছাড়া বনভূমি উজাড় হয়েছে কয়েক’শ একর।

পরিবেশ সংগঠন বেলার কলাপাড়া উপজেলার নেটওয়ার্ক মেম্বর মেজবাহ উদ্দিন মান্নু বলেন, গাছ আমাদের ছায়া। বারবার গাছের ওপর আঘাত আসাটা হুমকি স্বরুপ। যেভাবেই হোক গাছগুলো রক্ষা করা দরকার। আমাদের দাবি যে গাছগুলো উপড়ে পড়েছে সেগুলো যাতে অপসারণ করা না হয়। এখনি সময় নতুন ভাবে গাছ লাগানো ও পরিচর্যা করার।

পটুয়াখালী উপবন সংরক্ষক মো. সফিকুল ইসলাম বলেন, ঘূর্ণিঝড় রেমালে উপকূলের বনাঞ্চলের যে ক্ষতি হয়ে গেছে তা সত্যিই অপূরণীয়। তবে যেসব গাছগুলো উপড়ে গেছে তা আমরা সেখান থেকে সরাচ্ছি না। সরালে সয়েল ইরোসন কম হবে। ন্যাচারালি রিকভারি হবে। রিকভারি প্ল্যান হিসেবে আমরা চলমান বছরেই ঝাউ গাছ রোপন করবো।

উপদেষ্টা সম্পাদকঃ রোমান চৌধুরী।

প্রকাশকঃ  সানজিদা রেজিন মুন্নি।

সম্পাদকঃ কামরুজ্জামান বাঁধন।

নির্বাহী সম্পাদকঃ মোঃ জালাল উদ্দিন জুয়েল।

মোবাইলঃ ০১৭১১-৯৫৭২৬৩, ০১৭১২-৮৩১৪৪৭

মেইলঃ rhbnews247@gmail.com, CC: rhbnews.nd@gmail.com

ঢাকা অফিসঃ এ্যাড পার্ক, ওয়াজী কমপ্লেক্স (৯ম তলা), ৩১/সি, তোপখানা রোড, সেগুনবাগিচা, ঢাকা -১০০০.

error: Content is protected !!