
২৫ জুন ২০২৩ তারিখের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি ভাইরাল ভিডিওতে দেখা যায়, সোনালী ব্যাঙ্কের বরিশাল জেলার বাবুগঞ্জ উপজেলার খানপুর শাখায় উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউএনও ও উপজেলা প্রকৌশলীর বাদানুবাদ চলছে। ভিডিওতে দাবি করা হয়, ২০২২-২৩ অর্থবছরে সরকারের বার্ষিক কর্মসূচির বিশেষ বরাদ্দ হিসেবে ২ কোটি টাকার কাজ না-করেই উপজেলা চেয়ারম্যান ও ইউএনও নিজেদের যৌথ অ্যাকাউন্টে নিতে চাইলে উপজেলা প্রকৌশলীর বাধার মুখে তা সম্ভব হয়নি।
অথচ সরকারি নথিপত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এই ঘটনার মাত্র কয়েকদিন আগে সরকার ‘অনগ্রসর উপজেলা বিবেচনায়’ বাবুগঞ্জে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রীর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ৭ জুন তারিখে ৩০ লক্ষ এবং ১৫ জুন তারিখে উপজেলা কমপ্লেক্সের বিভিন্ন অফিস, বাসা-বাড়ী, গ্যারেজ, অভ্যন্তরীণ ড্রেন, রাস্তা, ঘাটলা ইত্যাদি মেরামত বাবদ ২০.৬৬ লক্ষ টাকা বরাদ্দ প্রদান করে।
কিন্তু সংশ্লিষ্ট উপজেলা প্রকৌশলী টেন্ডার প্রক্রিয়াকরণ না-করায় বরিশাল জেলা প্রশাসককে উপজেলা চেয়ারম্যান পত্র মারফৎ জানান, প্রকল্প বাস্তবায়নের লক্ষ্যে টেন্ডার আহ্বান ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য উপজেলা প্রকৌশলী ও সংশ্লিষ্ট সকলকে বারবার অনুরোধ করা সত্ত্বেও টেন্ডার প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করা হয়নি। অথচ বরাদ্দকৃত অর্থ ৩০শে জুন তারিখের মধ্যে ব্যয় করার বিষয়ে সরকারি সিদ্ধান্ত রয়েছে।
পত্রে তিনি আরও উল্লেখ করেন, আহ্বানকৃত টেন্ডারের আনুষ্ঠানিকতা সম্পাদনের জন্য তিনি সরকারি বিধি মোতাবেক দপ্তরে উপস্থিত হলেও স্বয়ং উপজেলা প্রকৌশলী নিজ দপ্তরে নির্ধারিত সময় অনুপস্থিত থাকায় তা সম্ভব হয়নি। এমতাবস্থায়, প্রকল্পসমূহ যথাসময় বাস্তবায়িত না-হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে।
এরূপ পরিস্থিতিতে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে উপজেলা চেয়ারম্যানের সভায় পবিত্র ঈদ-উল-আযহা উপলক্ষে নির্বাহী আদেশে ২৭ জুন সরকারী ছুটি ও ২৮, ২৯, ৩০ জুন ঈদের ছুটি থাকায় ২৬ জুন অর্থ বছরের শেষ কার্যদিবস হিসেবে বিবেচিত হওয়ায় এবং ২৫ জুনের মধ্যে প্রকল্পসমূহ বাস্তবায়ন শেষে অর্থ পরিশোধ বা মন্ত্রণালয়ে ফেরত প্রদানের নির্দেশনা রয়েছে বিধায় প্রকল্পসমূহের অর্থ সমুদয় বা আংশিক পরিশোধ করে বাকি অর্থ সোনালী ব্যাঙ্ক খানপুরা শাখায় সরকারের আয়ন-ব্যয়ন কর্মকর্তা হিসেবে উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও উপজেলা চেয়ারম্যানের যৌথ স্বাক্ষরে ‘এডিপি বিশেষ বরাদ্দ ২০২২-২৩’ নামে হিসাব খুলে রাখার জন্যে প্রস্তাব করেন। সভায় সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্তটি গৃহীত হয়। সভাতে উপজেলা প্রকৌশলীও উপস্থিত ছিলেন।
এই সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে ইউএনও সংশ্লিষ্ট উপজেলা প্রকৌশলীকে পত্র মারফৎ জানান যে, আর্থিক অনিয়ম, টেন্ডার প্রক্রিয়ায় অনিয়ম, যথাসময়ে কাজ শেষ না-হয়ে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে অর্থ ফেরত যাওয়াসহ যে কোনো ব্যত্যয়ের দায় উপজেলা প্রকৌশলীকে ব্যক্তিগতভাবে বহন করতে হবে।
এরপর ভাইরাল ঘটনার দিন ২৫ জুন ইউএনও উপজেলা পরিষদে ঢেউটিন বিতরণ শেষে উপজেলা চেয়ারম্যানের অনুরোধে সোনালী ব্যাঙ্কে পেলে উপজেলা প্রকৌশলীর সাথে সাক্ষাৎ হয়। ব্যাঙ্কে আলোচনার এক পর্যায়ে উপজেলা প্রকৌশলী তাঁর ব্যক্তিগত দায় সংক্রান্ত পত্রের কথা উল্লেখ করে উত্তেজিত হয়ে পড়েন এবং দাবি করেন যে, যৌথ অ্যাকাউন্টে তাঁকেও রাখতে হবে, যদিও সরকারি বিধি মোতাবেক তিনি সরকারের আয়ন-ব্যয়ন কর্মকর্তা নন। উপজেলা চেয়ারম্যান বিষয়টির প্রতিবাদ করে উপজেলা প্রকৌশলীর সাথে তর্কে জড়িয়ে পড়েন এবং উপজেলা প্রকৌশলীকে আলাদা রুমে চলে যেতে বলেন। ভাইরাল ভিডিওতে বিষয়টি স্পষ্ট দেখা যায়।
এমন সময় ইউএনও দু-জনকে দু-দিকে সরিয়ে দিয়ে পুলিশ ডাকেন। ব্যাঙ্কের সিসিটিভি ফুটেজে বিষয়টির সত্যতা পাওয়া যায়।
বিষয়টি ভাইরাল হওয়ার পর সরকারি কোনো নথিপত্রে উপজেলা প্রকৌশলীর দাবিকৃত ২ কোটি টাকা বরাদ্দের বিষয়ে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। এছাড়া, তাঁর উপস্থিতিতে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সভায় সর্বসম্মতিক্রমে যেই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে, সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে তাঁরই অসহযোগিতার বিষয়ে তিনি কোনো সন্তোষজনক জবাব দিতে পারেননি। এ বিষয়ে ইউএনও এর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান যে, সভায় সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত সিদ্ধান্তের বিষয়টি বাস্তবায়নের শেষ মুহূর্তে গিয়ে এ ধরনের ঘটনা সকলের জন্যেই বিব্রতকর। এটি একটি ভুল বুঝাবুঝি ছাড়া আর কিছুই নয়।
মন্তব্য করুন