বঙ্গোপসাগরে মাছের উৎপাদন ও প্রজনন বাড়াতে সরকারের ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে সমগ্র উপকূল অঞ্চল সহ মৎস্য বন্দর আলিপুর-মহিপুরের জেলেরা প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছেন। সরকারের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় ঘোষিত ৬৫ দিনের সমুদ্রে নিষেধাজ্ঞা শুরু হচ্ছে শুক্রবার (২১ মে) মধ্যরাত থেকে। এই নিষেধাজ্ঞা চলমান থাকবে রবিবার (২৩ জুলাই) মধ্যরাত পর্যন্ত। বঙ্গোপসাগর তৎসংলগ্ন সমুদ্রে মাছ শিকারের নিষেধাজ্ঞা শুরু হওয়াতে জেলেরা পরবেন অস্তিত্ব সঙ্কটে! একদিকে বছরে দু’বার নিষেধাজ্ঞা। অপরদিকে এই বছর ভড়া মৌসুমে সাগরে মাছের আকাল পরেছে। ঋনের বোঝা এবং ধার দেনায় জর্জরিত হয়ে জেলেরা রয়েছে চরম বিপাকে। ঐদিকে দীর্ঘ দিন কর্মহীন সময় পার করবেন তারা। তবে সরকার এই ৬৫ দিনের অবরোধের জন্য জেলে প্রতি ৫৬ কেজি করে চাল বরাদ্দ করেছে। সমুদ্রে বর্তমানে ইলিশ সহ অন্যান্য সামুদ্রিক মাছের প্রজননকাল হওয়ায় বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন নদীর মোহনায় এ নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। এই সময়ে দেশের সামুদ্রিক জলসীমানায় সব ধরনের মৎস্য শিকার, পরিবহন ও সংরক্ষণ নিষিদ্ধ ঘোষনায় প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সরকারের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। পটুয়াখালীর উপকূলীয় জেলেরা জানান, সরকারঘোষিত ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞায় সমুদ্রে মাছ শিকার করা যাবেনা। এতে মাছের প্রজনন ক্ষেত্র সুরক্ষিত থাকলেও উপকূলে এই পেশার সাথে জড়িত অর্ধ লক্ষাধিকের মতো মানুষের কর্মসংস্থান বন্ধ থাকবে দীর্ঘ দুই মাস। ভারাক্রান্ত কন্ঠে উপকূলের জেলে মোঃ মাহবুব আলম জানান, “কেমনে সংসারের ভড়নপোষন চালামু, আর কি খাইয়া বাঁচমু বউ পোলাপাইন লইয়া? অনেক এনজিও’র লোন টাহার ঋন লইয়া মানষিক দুশ্চিন্তায় মোর চোঁহে ঘুমে ধরেনা। আর মহাজনের দাদনের টাহা কেমনে পরিশোধ করমু? এহন হতাশ অইয়া গেছি। উপায়ান্তর না পাইলে মোর বেবাক্কেরে থুইয়া এলাকা ছাইরা পলাইয়া যাওন লাগবো, এছাড়া কোনো উপায় দেহিনা।” জেলে মাসুম ও সাইফুল বলেন, ১০ই মে থেকেই ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে নিরাপদে আশ্রয় নিতে অধিকাংশ জেলে বন্দরে অবস্থান নেয়। আবহাওয়া স্বাভাবিক হলে সমুদ্রে ৫ দিনের জন্য মাছ ধরতে গেলেও যারা এখনও সাগরে রয়েছেন তাদের ১৯ তারিখ রাত ১২টার মধ্যে ফিরতে হবে। এবছর একদিকে বৈরি আবহাওয়ার প্রভাব,তার মধ্যে সমুদ্রে মাছের আকাল। মাঝি সরোয়ার জানান, ট্রলারে কাজ করে গত বছর ৮০ হাজার টাকা ঋণ হয়েছে, তা এখনো পরিশোধ করতে পারিনি। আবার ৬৫ দিনের অবরোধ আসলে এই ঋণ পরিশোধতো দূরের কথা ঋণের বোঝা আরো বেড়ে যাবে। অনেক জেলে অভিযোগ করে বলেন, অবরোধকালীন সময়ে প্রতিবছর ভারতীয় জেলেরা বাংলাদেশের জলসীমানায় মাছ শিকার করলেও কোনো প্রশাসনের কোনো ভুমিকা দেখা যায়না। তা না হলে আমারা চাহিদানুযায়ী মাছ পেতাম। তাই মৎস্য প্রশাসন, নৌ পুলিশ সহ সংশ্লিষ্ট নিয়োজিত প্রশাসনের এই উদাসীনতা থেকে বেড় হয়ে দায়িত্বশীল ভুমিকা পালন করতে হবে। জেলেরা আরো দাবি করে বলেন, সরকার দু’বছরের স্থলে বছরে একবার সহ ভারতের সময়সীমার সাথে যেনো নিষেধাজ্ঞা (অবরোধ) জারি করা হয়। জেলে মাঝি কুদ্দুস মিয়া বলেন, “আমরা দীর্ঘদিন যাবৎ একটি দাবি করে আসছি, ৬৫ দিনের অবরোধকালে আমরা মাছ ধরা বন্ধ রাখলেও পার্শ্ববর্তী ভারতীয় জেলেরা আমাদের দেশের জলসীমায় প্রবেশ করে মাছ শিকার করে। কিন্তু সরকার এখনো এর কোনো প্রতিকার করতে পারলো না। আমাদের দাবি, এই সময়ে আমাদেরও মাছ শিকারে নিষেধাজ্ঞা শিথিল করতঃ নয়তো অবৈধভাবে ভারতীয় জেলে ট্রলারগুলো বাংলাদেশের জলসীমায় প্রবেশ বন্ধ করা হোক।” সাতভাই ফিসের পরিচালক মিজানুর রহমান জানান, পটুয়াখালীর সবচেয়ে বড় দুটি মৎস্য বন্দর আলীপুর-মহিপুর। এখান থেকে কোটি কোটি টাকার মাছ চালান হয় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। তবে গত কয়েক বছর যাবৎ বছরে দু’বার নিষেধাজ্ঞা, বৈরি আবহাওয়া, নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দামবৃদ্ধি। সব মিলিয়ে এই পেশা এখন হুমকির মুখে। দুই ট্রলারের মালিক খোকন বলেন, কোম্পানির কাছ থেকে ২০ লাখ টাকা দাদোন নিয়ে দুইটা ট্রলার তৈরি করেছি। ২ বছরে এখন পর্যন্ত লাভের মুখ দেখিনি। এর উপর আবার অবরোধ, এখন এই পেশায় টিকে থাকা আমাদের মতো মানুষের পক্ষে সম্ভব না। উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা অপু সাহা বলেন, “জেলেদের দাবি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পেশ করা হচ্ছে। এছাড়াও জেলেদের ঋন সহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির পরিকল্পনাও চলছে। উপজেলা মৎস্য প্রশাসন বাংলাদেশের সামুদ্রিক জলসিমায় সুষ্ঠ প্রজনন, উৎপাদন, সামুদ্রিক মৎস্য সংরক্ষণ এবং টেকসই মৎস্য আহরণের জন্য সকল প্রস্ততি সম্পন্ন করেছে।” কুয়াকাটা-আলীপুর মৎস্য আড়তদার সমিতির সভাপতি আনসার উদ্দিন মোল্লা বলেন, সরকার সমুদ্রে মাছের প্রজনন বৃদ্ধি ও জেলেদের স্বার্থে নিষেধাজ্ঞা দিচ্ছে। তবে সেটা যদি মৎস্য পেশাকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলে তাহলে অতি সম্প্রতি এই পেশায় সংকট দেখা দিবে। তাই আমাদের দাবি এই ৬৫ দিনের অবরোধকে কমিয়ে আনা হোক।