
পর্যটন নগরী কুয়াকাটা পৌর এলাকায় ১ দিনের টানা বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। পর্যটন উন্নয়নে পৌরসভা গঠনের ১ যুগ অতিক্রম হলেও পর্যাপ্ত ড্রেনেজ ব্যবস্থা না থাকায় ভোগান্তির চরমে এখন পৌর বাসিন্দারা। কুয়াকাটা ও পার্শ্ববর্তী লতাচাপলীর সংযুক্ত খালের পানি প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করে আটন জাল ফেলে প্রভাবশালীরা মাছ শিকার করছে এমন অভিযোগ ওই এলাকার বাসিন্দাদের। তারা বলছেন যে খালের পানি নামতে না পারার ফলে পৌর এলাকা সহ পার্শ্ববর্তী লতাচাপলী এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। কুয়াকাটা পৌর এলাকায় টানা ৫ দিন জলাবদ্ধতার কারন হিসেবে ড্রেনেজ ব্যবস্থা না থাকাকে দ্বায়ী করেছেন তারা। কুয়াকাটার আবাসিক হোটেল মোটেল থেকে শুরু করে কৃষিক্ষেত্র, মাছ চাষি সহ পৌর বাসিন্দারা নাগরিক সেবা থেকে বঞ্চিত থাকায় এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে ভূক্তভোগীরা। ড্রেনেজ ব্যবস্থার আকাল, পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থায় অদ্যবদি পৌর নাগরিকদের সেবায় কার্যত করতে না পারার ফলে পৌর কর্তৃপক্ষের দায়িত্বশীলতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে জনমনে। দ্রুত এ সকল ভোগান্তি নিরসনে কার্যকরী ব্যবস্থা করণে দাবি জানান কুয়াকাটার স্থানীয় বাসিন্দারা।
শনিবার (৩ আগষ্ট) সরেজমিন গেলে কুয়াকাটা পৌরসভার ৩, ৬, ৭, ৮ ও ৯ নং ওয়ার্ডের বাসিন্দারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, গত ৩০ জুলাই বৃষ্টিপাত শুরু হয়। এই বৃষ্টিপাত টানা ৫ দিন অব্যাহত রয়েছে। বৃষ্টিপাতের প্রথম দিনেই পৌর এলাকার নিচু জমি কয়েক ফুট প্লাবিত হয়। ১ দিনেই বৃষ্টির পানিতেই তলিয়ে যায় পৌর বাসিন্দাদের অনেকের ঘরের আঙ্গিনা। তবে বৃষ্টিপাতের দ্বিতীয় দিন থেকে টানা ৪ দিনের বর্ষনে নিচু জমির অসংখ্য বসতির মধ্যে পানি প্রবেশ করেছে। টানা ৪ দিন ধরে জমে থাকা পানির প্রকোপে অনেকেই নানামুখী ভোগান্তির মধ্যে রয়েছে। বৃষ্টিপাতের শুরু থেকে অনেকেই পানি বন্দী হয়ে পড়েন। এই পানি নিষ্কাশনের জন্য যেই খাল প্রধান ভূমিকা রাখছে সেই খালের স্বাভাবিক পানি প্রবাহ স্থবির রয়েছে। আর এতে করে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়েছে খালের দুই পাশে বসবাসরত বাসিন্দাসহ নিচু জমিতে কাচা বসত বাড়ির বাসিন্দারা। অপরদিকে কুয়াকাটা পৌরসভার সামান্য ড্রেনেজ ব্যবস্থাও কার্যকরী ভূমিকা রাখছে না পানি নিষ্কাশনে। পৌর এলাকায় ড্রেনেজ ব্যবস্থার অপর্যপ্ততা থাকায় জলাবদ্ধতার প্রধান কারন বলে মনে করছেন ভূক্তভোগী বাসিন্দারা। এতে কৃষিক্ষেত্র এবং অনেক মাছের ঘেড়ের ব্যপক ক্ষতিসাধন হয়েছে।
জানা গেছে, দেশের অন্যতম পর্যটন নগরী কুয়াকাটা। পর্যটন কেন্দ্র উন্নয়নের লক্ষ্যে ২০১০ সালের ১৫ ডিসেম্বর পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া উপজেলার লতাচাপলীর মৌজা নিয়ে গ শ্রেণীর পৌরসভা হিসেবে কুয়াকাটা পৌরসভা প্রতিষ্ঠিত হয়। এর আয়তন ৮.১১ বর্গ কিলোমিটার। বর্তমানে কুয়াকাটা পৌর শহরে প্রায় ২০ হাজার বাসিন্দা বসবাস করছে। তবে পৌরসভা গঠনের ১৪ বছরেও নাগরিকরা পাচ্ছে না কাঙ্খিত সেবা। পয়ো ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, সুপেয় পানি থেকে শুরু করে নাগরিকরা পাচ্ছেনা পৌর নগরীর সুফল। যার কারনে পৌর বাসিন্দাদের বাড়ির পেছনে গড়ে উঠেছে ময়লার ভাগার। এতে করে পরিবেশ প্রতিবেশে এর ব্যপক প্রভাব পড়েছে। উপদ্রব বেড়েছে মশা-মাছির, ছড়াচ্ছে নানা রোগ জীবানু। শহরের বর্জ্য ব্যাবস্থাপনায় স্থায়ী ডাম্পিং ব্যবস্থাও নেই।
কুয়াকাটা পৌর ৮ নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা আজিমুননেছা আক্ষেপ প্রকাশ করে বলেন, ভোটের সময় আইলে প্রার্থীরা মা ডাইকা যায়, উন্নয়ন করবে কইয়া খালি ভোট কামায়। পরে মোগো আর কোনো খবর রাহেনা। বৃষ্টির পানি কোনো দিকে নামেনা। মোরা এহন ভুগতে আছি পানিতে ডুইবা।
পৌরসভার খাল পাড়ের বাসিন্দা মোয়াজ্জেম জানান, বৃষ্টির প্রথমদিন থেকে আমাদের এখানকার প্রায় ঘরেই পানি না নামতে পারায় তলিয়ে আছে বেশ কয়েকদিন। বৃষ্টির পানি অথবা খালে জোয়ারের পানি বাড়লেই আমাদের সবচেয়ে ভোগান্তি হয়। একদিকে নেই পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা। অপরদিকে বর্জ্য ও পয়োনিষ্কাশনে নেই কোনো ব্যবস্থাপনা। আবার সুপেয় পানির ব্যবস্থাপনা এখনও পৌর এলাকার নাগরিক সেবায় কার্যকর করা হয়নি। আরেক বাসিন্দা আজাদ বলেন, সড়কে পর্যাপ্ত কালভার্ট ব্যবস্থা না থাকায় পৌর এলাকায় মূলত জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। এছাড়াও সম্ভবত স্লুইজ গেট আটকে রাখার ফলে পানি নিষ্কাশন হচ্ছে না। পৌর এলাকায় প্রধান কেন্দ্রে মাত্র কয়েক কিমি. ড্রেনেজ ব্যবস্থা রয়েছে, তাও পুরোপুরি সচল না। তিনি উল্লেখ করে বলেন, সমুদ্রে ভাটার সময় নদ-নদীর পানি কমলেও আমাদের এলাকায় খাল-বিলের পানি স্থবির হয়ে থাকার কারন কি? অবশ্যই পানি প্রবাহে বাধা প্রদানের ফলে পানির স্বাভাবি গতি প্রবাহ বন্ধ রয়েছে।
পৌর ৬ নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা মোঃ দুলাল ফকির জানান, কুয়াকাটা পর্যটন নগরীকে ঘিরে এই পৌরসভা গঠন করা হলেও নাগরিকররা দীর্ঘ ১৪ বছর অতিক্রম হলেও পৌর নগরীর কোনো সেবা আমরা পাচ্ছিনা। ১ দিনের টানা বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতার ভোগান্তিতে পরতে হয়। খালের দুই পাশের বাসিন্দাদের বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ে। পানি নিষ্কাশনের জন্য মাত্র একটি ড্রেনেজ ব্যবস্থা করা হলে তা ফাঁকা জায়গায় করা হয়েছে যা থেকে আমরা নাগরিকরা সুবিধা বঞ্চিত। যেসকল ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় ড্রেনেজ ব্যবস্থা প্রয়োজন রয়েছে সেদিকে নেই কোনো কার্যকরী ভূমিকা। আমরা যথারিতি শুধু পৌর কর পরিশোধই করে আসছি। তিনি আরো বলেন, পৌরসভায় ড্রেনেজ ব্যবস্থার আকাল একদিকে যেমন মারাত্বক প্রভাব ফেলছে জলাবদ্ধতার কারন হিসেবে। অপরদিকে কুয়াকাটা খালের বেশ কয়েকটি স্থানে বাঁধ রয়েছে। এবং আলীপুর স্লুইজ গেট আটকে সীমিত পরিসরে পানি নিষ্কাশন করা হচ্ছে। আবার খালের মধ্যে অবৈধভাবে শত শত আটন জাল পোতা রাখা হয়েছে। সেই আটন জালের মধ্যে ময়লা আবর্জনা আটকে থাকার ফলে পানির গতিপ্রবাহ হারাচ্ছে এবং খাল ভড়াট হয়ে যাচ্ছে। যার প্রভাবে খালের পানি কমে গেলে সৃষ্টি হয় আরেক জন ভোগান্তি। খালের পানি আটকে পচা দূরগন্ধ সহ মশা মাছির উপদ্রবে অতিষ্ঠ হয়ে পড়ে জনজীবন। এবিষয়ে পৌর কর্তৃপক্ষ ও উপজেলা প্রশাসনের নেই কোনো দায়িত্বশীল ভূমিকা। দ্রুত জলাবদ্ধতা নিরসনসহ খাল ভড়াটের হাত থেকে রেখাই পেতে দাবি জানান কুয়াকাটার বাসিন্দারা। একই গ্রামের গ্রামের বাসিন্দা মোঃ হোসেন জানান। প্রথম যে দুই দিন বৃষ্টি হয়েছে তাতে তেমন ক্ষতি হতো না যদি খালে অসংখ্য আটন জাল পোতা না থাকতো।
কুয়াকাটা ৩ নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা ইদ্রিস গাজী বলেন, আমি মাছের ঘের লীচ নিয়ে তেলাপিয়া ও পাঙ্গাস মাছ চাষ করেছি। এতে ২ লক্ষ টাকার মত ব্যায় হয়েছে। মাএ মাস খানেক পড়েই মাছ বিক্রির উপযোগী হত। কিন্ত টানা বৃষ্টির কারনে ঘেরের পাড় তলিয়ে সব মাছ চলে বেরিয়ে গেছে। এতবড় ক্ষতির মুখ থেকে কিভাবে ফিরবো সেটাই চিন্তা করছি।
লতাচাপলী ইউনিয়নের মুসুল্লীয়াবাদ গ্রামের সবজি চাষী আঃ রহিম জানান, জমিতে লাউ, জালি কুমরো, বেগুন , ফসল দিয়েছি। ঠিক মত পরিচর্চা করার কারনে গাছ গুলো সতেজ ছিলো। টানা বৃষ্টিপাত এবং পানি নামতে না পারার কারণে তলিয়ে আছে সব সবজি গাছ। এবার ব্যাপক ক্ষতির মুখে পরে গেলাম।
মিশ্রিপাড়া গ্রামের কৃষক সুশীল বিশ্বাস জানান, আমাদের জীবন জীবিকা চলে এই কৃষির উপরে নির্ভর করে। আমরা সারা বছর চেষ্টা করি ফসল ফলাতে। এবারেও অনেক ফসল সবজির চাষ করেছি। কিন্ত এই বৃষ্টির কারনে সব গাছ তলিয়ে আছে। পচন ধরার অবস্থা। এত পরিমান পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা না থাকায় ব্যপক ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। মৌসুমের আমন ধানের বীচতলা করেছি। সব বীচ পানির নিচে তলিয়ে আছে। এখন আর বীচ করার সময় ও নেই।
কুয়াকাটা পৌর মেয়র আনোয়ার হাওলাদার জলাবদ্ধতাসহ অন্যন্য বিষয়ে কোনো কথা বলতে রাজি হয়নি। তিনি জানান, কুয়াকাটা পৌর শহরে সড়কের প্রধান কেন্দ্রে ৮ কিলোমিটার ড্রেনেজ ব্যবস্থা করা হয়েছে। বর্তমানে ৪ কিলোমিটার ড্রেনেজের কাজ চলমান রয়েছে। অপরদিকে পৌরসভা এলাকায় মোট ১৫ কিমি. ড্রেনেজ ব্যবস্থার প্রয়োজন রয়েছে। তবে এই ড্রেনেজ ব্যবস্থা প্রকল্পের কোনো সুযোগ তার হাতে নেই বলেও জানান এই পৌর মেয়র।
কলাপাড়া ঝড় সতর্কীকরণ কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবদুল জব্বার জানান, আগামী ৭২ ঘণ্টা বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকতে পারে। সেই সঙ্গে উপকূলীয় এলাকায় দমকা বা ঝড়ো হাওয়া বয়ে যেতে পারে।
মন্তব্য করুন