সাগরকন্যা খ্যাত পটুয়াখালীর কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতের জিরো পয়েন্টেসহ মূল কেন্দ্রের দুইপাশে জিও টিউব এবং জিও ব্যাগ এখন মৃত্যুফাঁদ। সৈকতের মূল কেন্দ্রে প্রতিনিয়ত পর্যটকরা জোয়ারের সময় সমুদ্রে গোসলে নেমে পতিত হচ্ছে দূর্ঘটনায়। এমনকি সৈকতের জিরো পয়েন্টের দুই পাশে স্বাভাবিক চলাচলেও ভোগান্তি পোহাচ্ছে। তবে দেশের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র কুয়াকাটা সৈকতে এমন মারাত্বক ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও পর্যটকদের ভ্রমন সুবিধায় সৈকত নিরাপত্তা নির্দেশনাবলি না দেওয়া, এবং সৈকতে যথেষ্ট নিরাপত্তা ব্যবস্থার ঘাটতি থাকাই এর জন্য দায়ী বলে মনে করছেন আগত পর্যটকসহ স্থানীয়রা। দীর্ঘদিন এমন এমন অব্যবস্থাপনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন পর্যটকরা। পর্যটকসহ স্থানীয়দের দাবি দ্রুত জিও ব্যগের শেওলা দূর করার ব্যবস্থা ও সৈকতে পর্যটকদের সৈকত নিরাপত্তা নির্দেশনামূলক সতর্ক বার্তা, জোয়ার ভাটার তথ্য প্রচার করা, কুয়াকাটা দর্শনীয় স্পটের ভ্রমন তথ্যসহ বৈরী আবহাওয়ার সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা এবং সতর্ক সংকেত ও সংখ্যা দিয়ে বিপদের মাত্রা সংবলিত চিহ্ন অবহিত করা।

পদ্মাসেতু চালু হওয়ার পর থেকেই দেশের নানা প্রান্ত থেকে কুয়াকাটামুখী বাড়ছে পর্যটকদের আনাগোনা। সমুদ্রের তীরে এসে সৈকতের বালিয়াড়িতে পায়চারী করা ও উত্তাল ঢেউয়ে গা ভাসিয়ে দেওয়ার জন্য ব্যাকুল থাকেন আগত দর্শনার্থীরা। কিন্তু সৈকতে নামা ও গোসল করাটা যে বিপজ্জনক হয়ে উঠছে, এমন বিষয়ে প্রথমবারের মতো কুয়াকাটা ভ্রমনে এসে জানেন না অনেক পর্যটকরা। আবার পর্যটনের ভড়া মৌসুমে সৈকতের যে রূপ তা বর্ষায় ভিন্ন রূপ ধারন করায় অনেকেই এমন ঝুকিপূর্ণ বিষয়ে আচ করতে পারেন না। সমুদ্রপ্রেমী পর্যটকরা উত্তাল সমুদ্রে হৈ হুল্লোড়ে মেতে উঠতে ব্যাকুল হয়ে পড়েন; না জানার কারনে শিকার হয় মারাত্বক দূর্ঘটনায়। অপরদিকে শিশু, নারী ও বয়োবৃদ্ধ মানুষের জন্য জোয়ার ব্যতীতই স্বাভাবিক সৈকতের মধ্যে ঝুকি নিয়ে চলাচল করতে হয়। এরমধ্যেই অনেকে জিও টিউব এবং জিও ব্যাগের গর্ত সহ শ্যওলায় পা পিছলে ছিটকে পড়ে যায়।

সাম্প্রতিক সময়ে দেখা গেছে, সৈকতে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে কুয়াকাটায় আগত পর্যটকসহ স্থানীয়রা। পর্যটকরা কোনো ধরনের সতর্কতামূলক নির্দেশনা না দেখতে পেয়ে হুটহাট করে নেমে পড়ে সৈকতে। সৈকতে নামতে গিয়ে জিও ব্যাগের ফাঁদে পড়ে গিয়ে শিকার হন দুর্ঘটনার। ফলে আনন্দ ভ্রমণটি মুহূর্তে নিরানন্দে পরিণত হয়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পবিত্র ঈদুল আজহার পর থেকে এ পর্যন্ত জিও ব্যাগের কারণে প্রায় ত্রিশজনের বেশি পর্যটক মারাত্বক আহত হয়েছেন। এর মধ্যে একজনের পা ভেঙে গেছে। এছারাও প্রতিনিয়ত জিও ব্যাগে সৃষ্ট শ্যওলা এবং গর্তে পড়ে গিয়ে কমবেশি আহত হচ্ছেন।

সরেজমিনে দেখা যায়, সৈকতের বালুক্ষয় রোধে পানি উন্নয়ন বোর্ড ব্যবহার করছে জিও ব্যাগ। এই জিও ব্যাগ পুরো সৈকতে এলোমেলোভাবে পড়ে আছে। কোথাও কোথাও সৃষ্টি হয়েছে গর্তের। ফলে আগত পর্যটকসহ স্থানীয়রা যখনই সৈকতে নামতে যায় তখনি বিপদের সম্মুখীন হন। সমুদ্রে জোয়ারের পানিতে গোসলে নেমে জিও ব্যাগের শ্যাওলায় পা পিছলে প্রতি মুহূর্তে ভোগান্তি পোহাতে হয় নানা বয়সী মানুষের। ভাঁটার সময় থাকে ছিন্নভিন্ন বিশৃঙ্খলা পরিবেশ ও সৃষ্ট গর্তে হাঁটু থেকে কোমর সমান পানি জমে থাকে। ভাঁটা নাগাদ এমন উঁচুনিচু খাঁদে ঝুঁকি নিয়ে মানুষের স্বাভাবিক চলাফেরা করেন। জিও ব্যাগের সৃষ্ট বিপজ্জনক গর্তের মধ্যে দেখা গেছে কংক্রিটের বড় বড় টুকরার সঙ্গে রডের অংশসহ কাচ ভাঙা ও অপচনশীল প্লাস্টিকের বর্জ্য আটকে আছে। এর দ্বারা পর্যটকরা হাত-পা কেটে মারাত্মক দুর্ঘটনার শিকার হয়ে ভ্রমণের ইতি টেনে চলে যাচ্ছেন এক তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে। আবার সাঁতার না জানা পর্যটকদের কাছে ওই গর্তগুলো হয়ে ওঠে মরণফাঁদ।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে আগত পর্যটক মো. হিমেল বলেন, আমি সৈকতে নামতে গিয়ে পড়ে গিয়ে পায়ে প্রচণ্ড ব্যথা পেয়েছি। পা ফুলে গেছে। এই বিচে সতর্কতা সংবলিত লেখা থাকলে আমি সাবধানতা অবলম্বন করতাম। তাহলে আমার এ সমস্যা নাও হতে পারত।

ঢাকা থেকে আগত পর্যটক আবু নাসিম মুন্সি বলেন, সৈকতের অবস্থা দেখলে মনে ভয় কাজ করে। সমুদ্রের তীরে এসে যদি স্বাচ্ছন্দ্যে গোসল ও হাঁটাচলা না করা যায় তাহলে সৈকতে কেনো আসবে পর্যটক। জিরো পয়েন্ট থেকে শুরু করে আশেপাশে সব জায়গায় জিও ব্যাগ ফালানো এবং সেটা পিচ্ছিল হয়ে আছে। এটা দ্রুতই সমাধান না করা হলে পর্যটকের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। এর প্রভাবে অনেকেই আর আসতে চাইবে না।

পর্যটন ব্যবসায়ী মো. কে এম বাচ্চু বলেন, জিও ব্যাগ দিয়ে বেড়িবাঁধ সংরক্ষণের কাজ করা হয়েছে। এখন এগুলো পর্যটকদের কাছে আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই জিও ব্যাগের কারণে আহত এবং নিহত হওয়ার ঘটনা সংগঠিত হয়েছে। ব্যবসায়ী হিসেবে জোর দাবি করছি যাতে পর্যটকরা সেভ জোন ও রিস্কি জায়গাগুলো নির্দেশনায় জানতে পারে তার ব্যবস্থা করা।

ট্যুর অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন অব কুয়াকাটা (টোয়াক) প্রেসিডেন্ট রুমান ইমতিয়াজ তুষার বলেন, ঝুঁকি মুক্ত সৈকত করা দরকার। পুরো সৈকতে এখন জিও ব্যাগ একটা আতঙ্ক হিসেবে কাজ করছে। গর্ত আর শেওলা হওয়ার কারণে প্রতিনিয়ত ঘটছে দুর্ঘটনা। সৈকতে নামার জন্য কয়েকটি আরও স্পট তৈরি করা দরকার বলে মনে করছি। স্থায়ী প্রকল্পের মাধ্যমে বেড়িবাঁধ সংরক্ষণ করে নান্দনিক বিচ করলে পর্যটক আসবে, না হয় পর্যটকরা কুয়াকাটা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবে।

হোটেল মোটেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মোতালেব শরীফ বলেন, আমরা বিষয়টা নিয়ে ডিসি মহোদয় ও ইউএনও মহোদয়ের সঙ্গে আলোচনা করব। নিরাপত্তা নির্দেশনা না দিলে পর্যটকরা জানবে কি করে যে কোন জায়গাটা রিস্ক ফ্রি। এটা দেওয়া জরুরি হয়ে পড়ছে।

কুয়াকাটা বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটির সদস্য ও কুয়াকাটা পৌর মেয়র আনোয়ার হাওলাদার বলেন, পর্যটন কেন্দ্রকে ঘিরে কুয়াকাটা পৌরভার ঘঠন করা হলেও এর তদারকি করছেন বিচ ব্যবস্থাপনা কমিটি। যার আহবায়ক জেলা প্রশাসন ও সদস্য সচিব উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। কুয়াকাটা পৌরসভা চাইলেই অনেক কাজ করতে পারেনা। এর জন্য অনেক বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তবে আমি আহ্ববান করবো যাতে পর্যকটদের সুবিধার জন্য সৈকতে জিও ব্যাগে সৃষ্ট ঝুঁকিপূর্ণ যেসব স্থান রয়েছে এর জন্য যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ার।
তবে কুয়াকাটা পৌরসভার একাধিক সূত্র জানিয়েছে যে, সমুদ্র সৈকত তথা পর্যটকের সুবিধার জন্য পৌর কর্তৃপক্ষ নিরলস কাজ করলেও প্রশাসনের কিছু মহল তা দমিয়ে রাখতে নানা অপচেষ্টা চালাচ্ছে। যেখানে পর্যটকের নিরাপত্তায় এর পূর্বে সৈকতে রাতে আলোর ব্যবস্থা করা হলেও স্বার্থান্বেষীমহলের কারনে সৈকত এলাকা থাকে এখন অন্ধকারে নিমজ্জিত। এতে যেমন নিরাপত্তা ঝুঁকি রয়েছে পর্যটকদের অপরদিকে নানা অপরাধ সংগঠিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। পর্যটকের সেবার মান নিশ্চিতে এসব অব্যবস্থাপনা রোধে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে দাবী জানান বেশ কয়েকজন পৌর কাউন্সিলর।

কলাপাড়া উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা ও বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটির সদস্য সচিব মো. রবিউল ইসলাম বলেন, পৌর মেয়র, কুয়াকাটা ট্যুরিস্ট পুলিশ, হোটেল মোটেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের কর্মকর্তা নিয়ে ইতোমধ্যে একটি মিটিংয়ের আয়োজন করেছি। সেখানে আলোচনা হয়েছে সৈকতে পর্যটকদের সৈকত নিরাপত্তা নির্দেশনা দেওয়ার। শিগগিরই এটি স্থাপন করা হবে।

ট্যুরিস্ট পুলিশ কুয়াকাটা অঞ্চলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ বলেন, পর্যটকদের নিরাপত্তার বিষয়টি সবার আগে। এ বিষয়ে ইতোমধ্যে একটি মিটিং হয়েছে আশা করি খুব কম সময়ের মধ্যে কুয়াকাটা সৈকতে পর্যটকদের সৈকত নিরাপত্তা নির্দেশনা সংবলিত লেখা সাঁটানো হবে।