দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্র সৈকত পটুয়াখালীর পর্যটন নগরী কুয়াকাটায় ঈদুল আজহার তৃতীয় দিনে ব্যপক পর্যটকের আগমন ঘটেছে। মঙ্গলবার থেকে বুধবার দিনজুরে আগমন করেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ভ্রমন প্রিয় মানুষ। আগত দর্শনার্থীদের পদচারনায় মুখরিত হয়ে উঠেছে কুয়াকাটা সৈকতের কয়েক কিলোমিটার এলাকা। এবারের ঈদুল আজহার লম্বা ছুটিতে গত দুইদিনের ব্যবধানে অসংখ্য পর্যটকের ভিড়ে সমুদ্রকণ্যা খ্যাত কুয়াকাটায় পর্যটকের এক মিলন মেলায় পরিনত হয়েছে। কুয়াকাটার প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেনীর আবাসিক হোটেল-মোটেলের প্রায় শতভাগ বুকিং সম্পন্ন হয়েছে। এছাড়া তৃতীয় শ্রেনীর হোটেল গুলোতে ৬০-৭০ শতাংশ বুকিং সম্পন্ন রয়েছে এবং বৃহস্পতিবার আরো বুকিং বাড়বে বলে নিশ্চিত করেছে হোটেল মোটেল এমপ্লয়িজ এসোসিয়েশন। খাবার হোটেল গুলোতে ব্যবসায়ীদের দেখা গেছে কর্মব্যস্ততা। তবে বৈরী আবহাওয়ায় এবং টানা বৃষ্টিপাত থাকলে যে-সব পর্যটকরা বেশ কিছুদিন কুয়াকাটায় থাকার কথা রয়েছে তারা এর পূর্বেই চলে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে সূত্র জানিয়েছে।

কুয়াকাটায় আগত পর্যটকের সার্বিক নিরাপত্তায় উপজেলা প্রশাসন, ট্যুরিস্ট পুলিশ, থানা পুলিশসহ ফায়ার সার্ভিস, বিচ রেসকিউ টিম এবং রোভার স্কাউটের সদস্যরা তৎপর রয়েছেন। এছাড়া পটুয়াখালী জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সার্বক্ষনিক নিয়োজিত রয়েছেন।

এদিকে কুয়াকাটায় বাড়তি পর্যটকের আগমন ঘটলেও গত দুইদিন ধরে বৈরী আবহাওয়ার কারনে দর্শনার্থীদের ভ্রমন বিনোদনে বেগ পেতে হচ্ছে। মঙ্গলবার দিনজুরে আকাশে মেঘমালা থাকলেও আজ (বুধবার, ১৯ জুন) সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত টানা বৃষ্টিতে আগত পর্যটকদের এক ভোগান্তি সৃষ্টি হয়েছে। ঈদের আনন্দ উপভোগ করতে কুয়াকাটা এসে বৃষ্টির প্রভাবে যেন চার দেয়ালে বন্দী হয়ে পড়েছে পর্যটকরা। তবে বৃষ্টির মধ্যেও কিছু সংখ্যক উৎসুক পর্যটকদের থেমে নেই আনন্দ উন্মাদনা। অনেকে বৃষ্টি উপেক্ষা করেই সমুদ্রের নীল জলরাশির মোহে ঢেউয়ের মিতালীতে নেমে পড়েছেন গোসলে। কেউ আবার সৈকতের বালিয়াড়ীতে বৃষ্টিভেজা শরীরে দাঁড়িয়ে, পায়ে হেটে উপভোগ করছেন সমুদ্রের রূপ-জৌবন। প্রিয়জনের কাধে মাথা রেখে, হাতে হাতে হাত রেখে সৈকতের বালিয়াড়ীতে বসে মননে আকছেন ভালবাসার আলপনা। সকল মানুষই যেন এই সমুদ্রের লাবন্য ছোয়ায় ভুলে যায় জীবনের সমস্ত বিষাদ। ইট পাথরের ব্যস্ত নগরীর কোলাহল ছেড়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে একটু স্বস্তির নিঃশাস ফেলতে, সুবিশাল সমুদ্রের তীরে মুক্ত বাতাসের আবেশে ছুটে আসেন প্রকৃতি প্রেমী মানুষ। প্রাকৃতিক দূর্যোগ কিংবা বিশেষ কোনো কারন ছাড়া এই সমুদ্র সৈকতের তীরে প্রতিনিয়ত দেশি বিদেশী পর্যটকের সমাগম থাকে কমবেশি।

কুয়াকাটা উপকূল জুরে থেমে থেমে মূষল্ধারে বৃষ্টিতে ভ্যাপসা গরম থেকে সামান্য স্বস্তি ফিরলেও কর্মব্যস্ত মানুষসহ নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য এখন চরম ভোগান্তির কারণ হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন উপকূলের দিন মজুরসহ কুয়াকাটা সৈকত সংশ্লিষ্ট ক্ষুদ্র পেশার হাজারো মানুষ। যেখানে পর্যটকের উপড়ে নির্ভর করেই কয়েক হাজার মানুষের আয়ের একমাত্র উৎস। দীর্ঘদিন পরে কুয়াকাটায় পর্যটকের আগমনে পর্যটন নগরীতে প্রানচাঞ্চল্য ফিরলেও বৃষ্টির প্রকোপ যেন তা থমকে দিয়েছে। তবে এভাবে টানা বৃষ্টি চলতে থাকলে ব্যবসায়ীদের দূর্ভোগ কেটে ওঠার আশা পুরে ছাই হবে বলে জানান ব্যবসায়ীরা। দিনজুরে টানা বৃষ্টির কারণে পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো ছিল বন্ধ রাখা।

ঢাকার গাজীপুর থেকে আগত পরিবার নিয়ে ঘুরতে আসা পর্যটক মোঃ মাঈনুল আহসান বলেন, উত্তাল সমুদ্রের বড় বড় ঢেউ দেখতে কুয়াকাটায় বেড়াতে এসেছি। গতাকাল এসেই পর্যটকের ভিড় দেখে মুগ্ধ হয়েছি। আজকে আরো পর্যটকের আনাগোনা বেড়েছে। পরিবারের সকলে মিলে ঈদের আনন্দ উপভোগ করছি সমুদ্রের শহর কুয়াকাটায়। সময় হলে আবারো আসার ইচ্ছে আছে।

মাদারীপুর থেকে আগত পর্যটক দম্পতি রাজিয়া-বাহাউদ্দীন জানান, দক্ষিনাঞ্চল বাসীর জন্য কুয়াকাটা আশির্বাদ স্বরূপ। এটি দেশের একটি অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র। মূলত সমুদ্রের টানেই এখানে বার বার ছুটে আসি। আজ বৃষ্টির মধ্যে সমুদ্রের ঢেউয়ের দৃশ্য অন্যরকম ছিল। তবে বর্তমানে কুয়াকাটা অসংখ্য পর্যটক থাকলেও বৃষ্টির কারনে বেশিরভাগই মানুষই রুম থেকে বেড় হয়নি।

কুয়াকাটা বার্মিজ মার্কেটের কাপর ব্যবসায়ী হাসান জানান, বেশ কয়েকটি আবাসিক হোটেলের মাধ্যমে জানতে পেড়েছি তাদের প্রায় শতভাগ বুকিং রয়েছে। এছাড়াও গতকাল থেকেই পর্যটক আসতে শুরু করেছে। কিন্তু আজ টানা বৃষ্টির কারণে প্রায় সব দোকানপাট খোলা হয়নি। আমরা দোকান খুলে বসে থাকলেও এখন পর্যন্ত কোনো বেচা বিক্রি হয়নি। হয়তো বৃষ্টি কমলে কিছু বেচা বিক্রি হবে বলে আশা করছি।

সৈকতের আচার ব্যবসায়ী জহির রায়হান বলেন, গতকাল থেকে পর্যটকের ব্যপক আগমন হলেও তেমন ভালো বিক্রি হয়নি। আশা করেছিলাম আজ বেচাকেনার ধুম পড়বে। কিন্তু সকাল থেকে বৃষ্টির কারনে কোনো ক্রেতাই আসেনি।

ক্ষুদ্র ঝিনুক ব্যবসায়ী জাহিদুল ইসলাম গাজী বলেন, দীর্ঘদিন অপেক্ষায় ছিলাম যে ঈদের মৌসুমে যে ইনকাম হবে তা থেকে সামান্য পুঁজি করে বেশ কিছুদিন সংসার চালাবো। তবে আজ বৃষ্টিতে ইনকাম করার সেই সুযোগ হয়নি। আশা করছি আবহাওয়া ভালো থাকলে আগামী কয়েকদিনে কিছু আয় হবে।

কুয়াকাটা পর্যটন কেন্দ্র কেন ভ্রমনে আসবে পর্যটকরা এমন মন্তব্যে কুয়াকাটা ট্যুরিস্ট বোট ব্যবসায়ী সমিতির যুগ্ন সম্পাদক মোঃ ইলিয়াস আকন কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতের অন্যতম সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের বিরল দৃশ্য যা বিশ্বে অনন্য। যে কারনে দেশ তথা বিদেশি পর্যটকের আকর্ষনের কেন্দ্রস্থল। অপরদিকে সবুজের সমারহে বেষ্টিত দীর্ঘ ৩২ কিলোমিটার সৈকত, সমুদ্রের মাঝে জেগে ওঠা বিভিন্ন দ্বীপাঞ্চল, আবার স্বল্প সময়ের পথ ধরেই সুন্দর বনের একাংশ উপভোগ করা যায় যেখানে। আছে রাখাইন সম্প্রদায়ের প্রাচীন ইতিহাস ঐতিহ্য, জেলেদের জীবন চিত্র, জেলে পল্লী, মৎস্য বন্দর সহ প্রকৃতির এক অপার লীলাভূমি। কুয়াকাটা ভ্রমনে আসা অনেক পর্যটকের ধারনা যে এক বা দুই দিনের ব্যবধানে কুয়াকাটা দর্শনীয় স্পট ঘুরে দেখা শেষ করা যায়, কিন্তু তাদের অনেকেই আসলে সেভাবে কুয়াকাটাকে জানার চেষ্টা না করার ফলে এমন মন্তব্য করে থাকেন। কুয়াকাটার পর্যটন দর্শনীয় স্পট সমূহ ভ্রমের জন্য জল ও স্থল পথে নূন্যতম এক সপ্তাহ সময় লাগবে যা আমাদের অনেকেরই অজানা। তবে বর্ষা মৌসুমে সমুদ্র উত্তাল থাকার কারনে সমুদ্র সৈকতসহ পার্শ্ববর্তী কিছু ভ্রমন স্পট স্বল্প সময়ে ঘুরে শেষ করা গেলেও পর্যটনের ভড়া মৌসুমে দীর্ঘদিন সময় নিয়ে ভ্রমনের সুযোগ রয়েছে।

কুয়াকাটা হোটেল-মোটেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মোতালেব শরীফ বলেন, প্রতি বছর এ সময় আমাদের অধিকাংশ হোটেল এবং রিসোর্টগুলোর রুম বুকিং হয়ে যায়। কিন্তু এ বছর এখন পর্যন্ত ৭০ শতাংশ বুকিং আছে অন এভারেজে। সামনের শুক্রবার ও শনিবার হয়ত শতভাগ রিজার্ভড হয়ে যাবে হোটেল মোটেল ও রিসোর্টগুলো।

পুলিশ সুপার (পদোন্নতি) কুয়াকাটা রিজিওন মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ বলেন, পুরো সৈকত সিসি ক্যামেরা ধারা নিয়ন্ত্রিত, হেল্প ডেক্স এর মাধ্যমে পর্যটকদের নিরাপত্তা এবং পরামর্শ দিয়ে আমরা সর্বোচ্চ সহযোগিতা করে আসছি। ঈদুল আযহা কে কেন্দ্র করে পর্যটকের নিরাপত্তায় বাড়তি পুলিশ সদস্য মোতায়েন রয়েছে। টহল টিম সার্বক্ষণিক সকল বিষয়ে নজরদারি করছে।

কুয়াকাটা সৈকত ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য সচিব ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রবিউল ইসলাম জানান, ঈদের ছুটিতে বাড়তি পর্যটক আগমন কেন্দ্র করে সার্বিক প্রস্তুতি সম্পন্ন রয়েছে। দর্শনার্থীদের নিরাপত্তায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিয়মিত তৎপরতার পাশাপাশি তিনজন অতিরিক্ত ম্যাজিস্ট্রেট, স্কাউটের প্রয়োজনীয় সংখ্যক স্বেচ্ছাসেবক ও সৈকতে রেসকিউ টিম প্রস্তুত আছে।