
পটুয়াখালীর কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতের সৌন্দর্য বর্ধনে জেলা প্রশাসন উদ্যোগ নিলেও সৈকতের মালিকানা দাবীতে একটি গ্রুপের মামলার জটিলতায় আটকা পড়েছে উন্নয়ন কর্মকান্ড। কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতকে আধুনিকায়নে, জিরো পয়েন্টের পশ্চিম পাশ এলাকার সীমা নির্ধারণে চলমান মামলার জটিলতায় সৈকতের মূল কেন্দ্রে পরিকল্পিত পর্যটন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিভিন্ন সময়ে সৈকতের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে দিলেও প্রশাসনের এ নিয়ে পড়তে হয় মালিকানা দাবিদারদের নানা প্রশ্নের মুখে। প্রশাসন বলছে স্বাভাবিক জোয়ারের পানি তীরের যে পর্যন্ত আছড়ে পড়ে তা সরকারি সম্পত্তি, কিন্তু এই নিয়মের কোনো তোয়াক্কা নেই মালিকানা দাবিদারদের। এতে করে প্রশাসন সমুদ্র সৈকতের সৌন্দর্য বর্ধনের উদ্যোগ নিলেও কার্যত হচ্ছেনা উন্নত ব্যবস্থাপনা।
সরেজমিনে জানা গেছে, কুয়াকাটা সৈকতের জিরো পয়েন্টের পশ্চিম পাশে জে এল ৩৪ নম্বর লতাচাপলী মৌজার ১২২৭ নম্বর একটি লুচ খতিয়ানের মালিকানা দাবি করে আসছেন মোঃ শাহজালাল মিয়া গংরা। ইতোপূর্বে এই খতিয়ানটি ২০১০ সালে স্থানীয় ভূমি প্রশাসন বাতিল করে দেন। এর বিরুদ্ধে শাহ জালাল মিয়া গংরা আদালতের শরণাপন্ন হয়। আদালত ২০১০ সালে ওই বিরোধীয় জমির ওপর অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। কিন্তু ইতোমধ্যে সেসকল জমির ৯০ শতাংশ সমুদ্র গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। যার কিছু অংশ ভাটা নাগাদ স্থলভাগে থাকলেও দৃশ্যমান কয়েকটি স্থাপনা ছাড়া বাকি থাকা সামান্য জমি স্বাভাবিক জোয়ারের পানিতে তলিয়ে যায়। কিন্তু জমির মালিকানা দাবীতে থাকা গ্রুপ এটি মানতে নারাজ। এর আগে সর্বশেষ গত (২১ নভেম্বর) উপজেলা ভূমি প্রশাসন সৈকতের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করতে গিয়ে শাহজালাল মিয়ার এর বাকবিতন্ডার মুখে পড়েন। এতে সৈকত এলাকায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে।
২০১১ সালে হাইকোর্টের নির্দেশে গঠিত কমিটি সৈকত এলাকার সীমানা নির্ধারণ এবং নতুন করে দখল ও নতুন স্থাপনা যাতে নির্মাণ করা না হয়, সে বিষয়ে নির্দেশনা দেয়া থাকলেও মামলা নিষ্পত্তির এ সময়ক্ষেপণের সুযোগে নতুন করে অবৈধ স্থাপনা করা হচ্ছে বলে উচ্ছেদ অভিযান অব্যাহত রয়েছে। মামলা কার্যক্রম দীর্ঘায়িত করতে নানা প্রভাব কাজ করছে এখানে বলে উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়।
এবিষয়ে মোঃ শাহজালাল হাং বলেন, সরকারের (নদী) আইনের ধারা অনুযায়ী আমাদেরকে যে সিদ্ধান্ত দেয়া হবে তা আমরা মেনে নিবো। তিনি অভিযোগ করে বলেন, এই জমি নিয়ে আদালতে একটি মামলা চলমান রয়েছে। তার অভিযোগ, জেলা প্রশাসন, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, এসিল্যান্ড, তহশীলদার সহ ৫ জনের বিরুদ্ধে এই জমিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন আদালত। কিন্তু সেই নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে কিভাবে উচ্ছেদ করা হয় এমন প্রশ্ন তার। তিনি আরো বলেন, প্রশাসন বর্তমান কুয়াকাটা পৌর মেয়রের ইন্ধনে এমন কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছেন। আরো অভিযোগ করেন, বর্তমান পৌর মেয়র চাইছেনা যে পশ্চিম পাশে কোনো স্থাপনা থাকুক। পৌর মেয়র এবং প্রশাসন মিলে সৈকতের পূর্ব পাশে একটি মার্কেট করেছেন যা আমাকে নিঃস্ব করার জন্য। তারা জোর করে ব্যবাসায়ীদের মার্কেটে নিয়ে বসাচ্ছেন।
তবে স্থানীয় ভাসমান ব্যবসায়ীদের সাথে এ বিষয়ে কথা হলে তারা বলছেন ভিন্ন কথা। স্থানীয় ব্যবাসায়ীরা বলছেন, আমরা বিভিন্ন সময়ে সমুদ্রের নানা প্রাকৃতি দূর্যোগে ক্ষতিগ্রস্তসহ সৈকতের বিভিন্ন পয়েন্টে পরিবেশের অনুপোযোগী দোকানপাট বসানোর কারনে প্রতিবছর প্রশাসন কর্তৃক উচ্ছেদের শিকার হই। যার প্রেক্ষিতে আমাদের কয়েকশতাধিক ছিন্নমূল ব্যবসায়ীরা সৈকতের যেকোনো একটি জায়গার মধ্যে স্থায়ী মার্কেট নির্মাণের দাবিতে মানববন্ধন পর্যন্ত করেছি। যদি কোনো ব্যক্তি বলে থাকেন ব্যবাসায়ীদের জোর করে মার্কেট করে বসানো হয়েছে তা হবে উদ্দেশ্যপ্রনীত। আমাদের দাবির ভিত্তিতেই সৈকতে মার্কেটটি করা হয়েছিলো।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) বরিশাল বিভাগীয় সমন্বয়ক লিংকন বায়েন বলেন, বাংলাদেশ পানি আইনে উল্লেখ রয়েছে যে বেড়িবাঁধের বাইরে যত জমি আছে এবং যে পর্যন্ত জোয়ারের স্বাভাবিক পানি তীরভূমিতে উঠে আসে, সেই পর্যন্ত সরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হবে। ওই জমি ব্যক্তিমালিকানার হলেও ইচ্ছেমতো কোনো স্থাপনা নির্মাণ করা যাবে না।
কুয়াকাটা পৌর মেয়র আনোয়ার হাওলাদার জানান, কুয়াকাটা সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য জেলা প্রশাসন ও উপজেলা প্রশাসন যে উদ্যোগ নিবেন সেখানে আমার কোনো হাত নেই। জোর করে সৈকতে মার্কেট স্থাপনের বিষয়ে তিনি বলেন, এই মার্কেট সাবেক জেলা প্রশাসন মোঃ কামাল হোসেন মহোদয়ের নির্দেশে স্থাপন করা হয়েছিলো।
এ বিষয়ে কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতে যদি কেউ নিজস্ব জমিতেও কোনো প্রকার স্থাপনা নির্মাণ করেন এতে বিভাগীয় কমিশনার মহোদয়ের অনুমতি নিতে হবে। সমুদ্র সৈকতে বেশ কিছু স্থাপনা রয়েছে যাহাতে আদালতের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তবে নতুন স্থাপনা নির্মাণের অনুমতি নেই। জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে সৈকতের ভাসমান ব্যবসায়ীদের জন্য একটি স্থায়ী মার্কেট করা হলেও তারা সেখানে থাকছেন না। কুয়াকাটা বীচ ম্যানেজমেন্ট কমিটির উদ্যোগে একটি মার্কেট নির্মানের পরিকল্পনা রয়েছে। যেহেতু সমুদ্র সৈকত এলাকা একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। এই পর্যটন নগরী ঘিরে কুয়াকাটা মাস্টার প্লান এবং উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ তৈরী হচ্ছে, সে ক্ষেত্রে আমাদের মার্কেট স্থাপনে কিছুটা বিলম্ব হচ্ছে। শাহজালাল মিয়ার অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তার মার্কেট আমরা উচ্ছেদ করছি না। তার স্থাপনা নিয়ে ইতোমধ্যে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) হাইকোর্টে রিট করেছে। যেখানে বলা আছে সৈকতে নতুন কোনো স্থাপনা নির্মান করা যাবেনা। কিন্তু নিয়ম না মানার কারনে তাদের নতুন স্থাপনা উচ্ছেদ করা হচ্ছে। এছাড়াও পর্যটন কেন্দ্র কুয়াকাটার সৌন্দর্য বর্ধনে ইতোমধ্যে সড়ক দখল করে বিশৃঙ্খলভাবে চৌকি পেতে বসা অনেক ভাসমান ব্যবসায়ীদের উচ্ছেদ করা হয়েছে। আমাদের উচ্ছেদ অভিযান অব্যাহত থাকবে।
মন্তব্য করুন