
ঘূর্নিঝড় সিডরের ভয়াল সেই ১৫ নভেম্বর, ১৬ বছর পরেও উপকূলীবাসীর দাবী- ভাত চাই না-ত্রাণ চাই না, চাই একটা টেকসই বেড়িবাঁধ
ভয়াল সেই ১৫ নভেম্বর, কলাপাড়াসহ উপকূলবাসীর বিভীষিকাময় এক দু:স্বপ্নের ও ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞের শিকার দিন। ২০০৭ সালের এই দিনে বিস্তীর্ণ এলাকা লন্ডভন্ড হয়ে ধ্বংসলীলায় পরিণত হয়। মুহূর্তের মধ্যেই প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস ক্ষতবিক্ষত করে দেয় বিভিন্ন এলাকার জনপদ। উপকূলীয় জনপদগুলো মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়। শতাব্দীর ভয়াবহ এ ঘূণিঝড়ে নিঁেখাজ ও প্রাণ হারিয়েছিলো বহু মানুষ।
২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর, এখনও এক দু:স্বপ্ন, ঘর-বাড়ী আর সহায় সম্বল হারিয়ে মানুষ হয়ে পড়েছিলো অসহায়। সিডরের ক্ষয় ক্ষতি এখনও বহন করে চলেছে অধিকাংশ পরিবার। এক এক করে ১৬ বছর পেরিয়ে গেল। আজও কান্না থামেনি স্বজনহারা মানুষের। রয়ে গেছে সেই ক্ষত। কিন্তু এত বছর পরেও ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় প্রয়োজনীয়-পর্যাপ্ত আশ্রয় কেন্দ্র গড়ে ওঠেনি, দুর্গম চরাঞ্চলের মানুষ আজো প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর জলোচ্ছ্বাসের ঝুঁকিতে রয়েছে।
মঙ্গলবার সরেজমিনে এলাকার বিভিন্ন দুর্যোগপ্রবণ এলাকা ঘুরে জানা যায়, ২০০৭ সালের ১৪ নভেম্বর সারা দেশের আকাশ ছিল মেঘলা। আবওহায়াবিদরা প্রথমে ৫ নভেম্বর থেকে সংকেত দিতে থাকেন। রাতে তা বৃদ্ধি হয়ে ৮ নম্বর বিপদ সংকেতে গিয়ে পৌছায়। ১৫ নভেম্বর সকালে ঘোষনা করা হয় সিডর নামের ঘূণিঝড় এগিয়ে আসছে বাংলাদেশ উপকূলীয় অঞ্চলে। দুপুর নাগাদ তা বাংলাদেশের উপকূল অতিক্রম করবে ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত। রাত সাড়ে ১০ টার দিকে সিডর আঘাত হানলো উপকূলীয় এলাকায় ঝড়ের তীব্রতা কমে যাওয়ার পর শুরু হয় স্বজনদের খোজাখুঁজি। ১৬ বছর পেরিয়ে গেলেও সেই দিনের দু:সহ স্মৃতি আজো জেগে আছে স্বজন হারাদের মনে, সেই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারেনি উপকূলবাসী, স্বাভাবিক হয়নি সিডর বিধ্বস্ত উপকূলবাসীর জীবনযাত্রা। সিডরের ক্ষয়-ক্ষতি এখন ও বহন করে চলেছেন অধিকাংশ পরিবার।

এলাকার ভুক্তভোগী প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর জলোচ্ছ্বাসের ঝুঁকিতে থাকা মানুষের একটিই দাবী-মোগো গ্রামে কোনও বাঁধ নাই রাবনাবাঁধ ও আন্দারমানিক নদী হগোল (সব) বাঁধ গিল্লা খাইয়া হালাইছে। এহোন ভাঙা বাঁধ দিয়া জোবার (জোয়ার) পানি ঢুইক্যা মোগো গ্রামের ঘর-দুয়ার জায়গা-জমি মাঠ-ঘাট হগোল পানিতে তলাইয়া যায়। মোরা ভাত চাই না ত্রাণ চাই না, চাই একটা টেকসই বেড়িবাঁধ। কথাগুলো বলছিলো উপকূলীয় এলাকা কলাপাড়া বেড়িবাঁধ বিহীন ধানখালী, লালুয়া, ধুলাসার, মহিপুর, নীলগঞ্জ, মিঠাগঞ্জ এলাকার ভুক্তভোগীরা।
তথ্য সূত্রে জানা যায়, ১৫ নভেম্বর সিডর তান্ডবের ঠিক ১৬ বছর আগে কালো রাত্রিতে বঙ্গোপসাগর থেকে প্রায় পৌনে ৩০০ কিলোমিটার বেগে ধেয়ে আসা ঘূর্ণিঝড় সিডর বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলীয় উপকূলে আঘাত হেনেছিল। মাত্র কয়েক মিনিটে ১০ থেকে ১২ ফুট সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হয়ে যায় বিস্তীর্ণ এলাকা। নিমেষেই উড়ে যায় ঘরবাড়ি, গাছ-পালা। মাটির সাথে মিশে যায় বহু স্থাপনা, রাস্তা ঘাট, পশু-পাখি ও জীবজন্তু। বিধ্বস্ত হয় বেড়িবাঁধ। আহত হয় হাজারো মানুষ। প্রাণ হারায় এই এলাকার ৯৪ জন মানুষ। সেই অভাবনীয় দুর্ভোগের রাতে অনেকের সাজানো সংসার চিরতরে হারিয়ে যায়, ভেঙে যায় অনেকের লালিত স্বপ্ন। প্রকৃতি যে মানুষের ওপর এতটা নিষ্ঠুর আচরণ করতে পারে ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বরের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় সিডর তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। কোনো দিন ওই স্মৃতির কথা ভুলতে পারবে না উপকূলীয় এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত হাজারো মানুষ। এ রাতে শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়াল সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস ও ঘূর্ণিঝড় উপকূলীয় অঞ্চল লন্ডভন্ড করে দেয়। উপকূলীয় অঞ্চলের শত শত মানুষের জীবন প্রদীপ নিভে যায়। মারা যায় হাজারো গবাদি পশু। আগের দিনও যে জনপদ ছিল মানুষের কোলাহলে মুখরিত, মাঠ জুড়ে ছিল কাঁচা-পাকা সোনালি ধানের সমারোহ, পরের দিনই সেই চিরচেনা জনপদ পালটে যায়। এ দিন বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নি¤œচাপে সকাল থেকে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল। নি¤œচাপটি কয়েকবার গতি পরিবর্তন করে মধ্যরাতে অগ্নিমূর্তি ধারণ করে।
রাতে ঘূর্ণিঝড়টি আঘাত হানে ভোলা, পটুয়াখালী, বরগুনার উপকূলীয় অঞ্চলে। সিডর আঘাত হানার পর ১৬ বছর পেরিয়ে গেলেও ক্ষতিগ্রস্তরা বাঁধের যথাযথ সংস্কার কিংবা পুনর্র্নিমাণ না হওয়ায় সাগর পাড়ের বাসিন্দাদের আতঙ্ক পিছু ছাড়ছে না। খোঁজ নিয়ে অরো জানা যায়, উপজেলার মানুষকে প্রতি বছর ঝড়-জলোচ্ছ্বাস মোকাবিলা করে চলতে হয়। প্রয়োজনের তুলনায় আশ্রয়কেন্দ্রের সংখ্যা কম হওয়ায় ২,৩৭,৮৩১ জন মানুষ চরম ঝুঁকিতে বাস করছে। এ অবস্থায় যে পরিমাণ আশ্রয়াকেন্দ্র রয়েছে তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল্য। তাই যেকোনো দুর্যোগ এলেই চরাঞ্চল থেকে মানুষকে অনেক ঝুঁকি নিয়ে মূল ভূখন্ডে নিরাপদ আশ্রয়ে আনতে হয়। আবার অনেকে চরম ঝুঁকি নিয়ে চরেই বসবাস করে। ভয়াবহ সুপার সাইক্লোন সিডরে এ উপজেলায় ৯৪ জনের মৃত্যু হয়। আহত হয় এক হাজার ৭৮ জন। সেই ঘটনার জের ধরে আজো নিখোঁজ রয়েছেন ৮ জেলে। স্বজন হারাদের কাছে তাদের খোঁজ খবর নিতে গেলে তারা বারবার কান্নায় ভেঙে পড়েন।
সিডরের তান্ডবে নিজামপুর ও কমরপুর পয়েন্টের ৪৭/১ পোল্ডারের বাঁধটি ভেঙ্গে যায়। এর পর কয়েক দফা মেরামত করা হলেও বঙ্গোপসাগর লাগোয়া আন্ধার মানিক নদী মোহনার ঢেউয়ের তোড়ে ফের বাঁধটি বিধ্বস্ত হয়ে ঝুঁকিতে রয়েছে। মেরামত কাজ অত্যন্ত নি¤œমানের হওয়ায় এ বাঁধ পুন:রায় বিবধস্ত হয়েছে, বাঁধটি ঝুঁকিপূর্ন অবস্থায় রয়েছে বলে স্থানীয়রা জানান।
পানি উন্নয়ন বোর্ড পটুয়াখালী ও কলাপাড়া অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, কলাপাড়া সার্কেলের অধীনে রয়েছে রয়েছে ৫১৮ কিলোমিটার। এর মধ্যে ক্ষতি গ্রস্থ বেড়িবাঁধ রয়েছে ৬ কি.মি। নিজামপুর গ্রামের সাবেক প্রা:বি: প্রধান শিক্ষক শামসুল হক ভদ্র বলেন, সিডরের ভাঙ্গা বেরিবাঁধ এখনও রয়ে গেছে। কোনে রকম রাস্তা দিয়ে পানি প্লাবন ধামানো হয়েছে ও বালির বস্তা দেওয়া হয়েছে কিন্তু আবার সিডরের মত বন্যা হলে ওই বাধ কোন কাজে আসবে না। রাবনাবাদ নদীর ঢেউয়ের তোড়ে দেবপুর বেড়িবাঁধের করমজাতলা অংশের ২৩৮ মিটার বাঁধ স্ল্যাবসহ ধ্বসে পড়েছে। এতে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন ধানখালী ও চম্পাপুর ইউনিয়নের মানুষ।
চম্পাপুর ইউপি চেয়ারম্যান মো. মাহবুব আলম বাবুল মৃধা জানান, দেবপুর বেড়িবাঁধের করমজাতলা অংশটি এ বাঁধের দেবপুর অংশের মেরামত করা হলেও এই অংশটি থেকে গেছে অরক্ষিত। কিন্তু এলাকার মানুষের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা কমেনি।
ধানখালী ইউপি চেয়ারম্যান শাহজাদা পারভেজ টিনু জানান, এবছর বর্ষা মৌসুম শুরুর পরই টিয়াখালী নদীর ভাঙ্গনে হাফেজ প্যাদা বাঁধের বিভিন্ন অংশ নদীতে ধ্বসে পড়েছে। মিঠাগঞ্জ ইউপি চেয়ারম্যান মেজবাহ উদ্দিন খান দুলাল জানান, মিঠাগঞ্জ বেড়িবাঁধের ১০০ মিটার বাঁধ সোনাতলা নদীর ¯্রােতে স্ল্যাবসহ ধ্বসে পড়েছে। এতে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন সাত গ্রামের মানুষ।
মহিপুরের ভারপ্রাপ্ত ইউপি চেয়ারম্যান জাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, আরো বছরখানেক আগে চিকনভাবে ছোট রাস্তা করেছে। মজবুত ভাবে বেরিবাঁধ করে নাই। তাই ওখানে ১ কিলোমিটার বাঁধ ঝুঁকিতে রয়েছে। একই অবস্থা কলাপাড়ার নীলগঞ্জ ইউনিয়নের গইয়াতলা বেড়িবাঁধের। এ বাঁধের প্রায় ৩০০ মিটার নদী গর্ভে ভেঙ্গে গেছে।
কলাপাড়া সিপিপি কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান বলেন, উপকূলীয় এই এলাকায় দুর্যোগ মোকাবিলায় বর্তমানে ১৭০টি আশ্রয় কেন্দ্রের পাশাপাশি ২০টি মুজিব কিল্লা নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়াও এলাকার ৩,১৬০ জন সিপিবি কর্মী দুর্যোগকালে মাঠে কাজ করেন। দুর্যোগপ্রবণ দুর্যোগ প্রতি রোধে আমরা অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছি। সব ধরনের দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য আমরা এখন সক্ষম।
কলাপাড়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রাকিব হোসেন জানান, ক্ষতিগ্রস্থ বেঁরিবাধ সরেজমিনে পরিদর্শন করে শুস্ক মওসুমে মেরামত করা হবে। ক্ষতিগ্রস্থ ৬কি:মি: বেরিবাঁধ রয়েছে তা উর্ধŸতন কর্তৃপক্ষ জানানো হয়েছে।
এবিষয়ে জানতে চাইলে কলাপাড়া নির্বাহী কর্মকতা জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, আগের চেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ বেরিবাঁধ অনেক কমে গেছে। যে কোন বন্যা নিয়ন্ত্রন করার জন্য সাইক্লোন শেল্টার প্রস্তুত রয়েছে ও ১৭০টি আশ্রয় কেন্দ্রের পাশাপাশি ২০টি মুজিব কিল্লা নির্মাণ করা হয়েছে।
মন্তব্য করুন