
বঙ্গোপসাগর তৎসংলগ্ন সমুদ্রে মাছ শিকারে ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা শুরু হচ্ছে আজ মধ্যরাত থেকে। মা ইলিশের বাধাঁহীন প্রজননে মৎস্য বিভাগের জারিকৃত নিষেধাজ্ঞা পালনে ইতোমধ্যে উপকূলের জেলে ও ব্যবসায়ীরা নিচ্ছেন শেষ সময়ের প্রস্তুতি। তবে জেলেদের মাছ শিকারে নিষেধাজ্ঞায় চরম বিপদগ্রস্ত করে ফেলেছে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় ঘোষিত ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞায় দেশের সামুদ্রিক জলসীমায় সব ধরনের মৎস্য শিকার, আহরন, পরিবহন, বাজারজাত করনসহ ক্রয়- বিক্রয় নিষিদ্ধ নিষিদ্ধ ঘোষনা করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।
২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা চলাকালীন নিবন্ধিত জেলেদের জন্য দেয়া হচ্ছে (ভিজিএফ) খাদ্য সহায়তা। কলাপাড়া উপজেলায় নিবন্ধিত জেলের সংখ্যা প্রায় ১৯ হাজার। প্রকৃতপক্ষে অনিবন্ধিত জেলেসহ প্রায় ৩০ হাজারের মতো জেলে রয়েছে এই উপজেলায়। জেলেদের অভিযোগ রয়েছে নিবন্ধনের এই তালিকা কার্ডধারী এক চতুর্থাংশ জেলে ভুয়া। বিভিন্ন পেশার লোক জেলে কার্ড করে সুবিধা ভোগ করছে। আর প্রকৃত জেলেরা শত শত বাদ পড়েছেন। এতে অভাবগ্রস্ত জেলেরা দিশাহারা হয়ে পড়েছেন। মৎস্য বন্দর আলীপুর-মহিপুরসহ কুয়াকাটা উপকূলীয় জেলেদের দাবি নিষেধাজ্ঞা চলাকালীন নির্ধারিত সময়ে প্রকৃত জেলেদের মাঝে খাদ্য সহায়তার পরিমাণ বৃদ্ধিসহ আর্থিক সহায়তা প্রদান করা এখন সময়ের দাবি।
২০১৫ সালে এই নিষেধাজ্ঞা চালু হলে শুরুতে শুধু ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রলার এর আওতাভুক্ত থাকলেও ২০১৯ সালে সব ধরনের নৌযানকে এই নিষেধাজ্ঞার আওতায় আনা হয়। জেলেরা এই সময়ে মৎস্য সংস্লিষ্ট পেশায় জড়িত লক্ষাধিক মানুষ কর্মহীন হয়ে পরেন। কলাপাড়া উপজেলায় প্রায় ৪০টি জেলে পল্লীর রয়েছে।
এর মধ্যে আলীপুর ,মহিপুর, লালুয়া, কুয়াকাটা, ধুলাসার, ধানখালী, বাবলাতলার ঢোস, নিজামপুর, গঙ্গামতির জেলেরা বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। জেলেদের অভিযোগ রয়রছে জেলে তালিকায় অর্ন্তভুক্ত মৎস্য শিকারিদের সরকার ভিজিএফ’র আওতায় খাদ্য সহায়তার ব্যবস্থা করেন। দীর্ঘ এ সময়ে প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ জেলে পেশা পরিবর্তণ করে ভিন্ন পেশায় ঝুঁকেছেন। তবে তালিকা হালনাগাদ না হওয়ায় বর্তমানে সরকারের প্রদেয় এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন প্রকৃত জেলেরা।
জেলেদের সাথে কথা হলে তারা জানান, গত ২৩ জুলাই দীর্ঘ ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা শেষে সমুদ্রে মাছ শিকারের উদ্দেশ্যে গিয়ে এবছর ১০-১২ বার দফায় দফায় বৈরী আবহাওয়ার কবলে পরেছেন তারা। আবার শুরু হচ্ছে ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা। বিগত বছরের তুলনায় জেলেসহ ব্যবাসীরা পরেছে এক চরম দূর্দিনের মধ্যে। চলতি বছর ভরা মৌসুমেও কাঙ্খিত মাছ শিকার করতে না পেরে ঋনের চাপে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন গভীর সমুদ্রসহ উপকূলের জেলেরা।
এদিকে উপকূলের খুটা জেলেরা জানান, গত কয়েক বছর ধরে সমুদ্র তীরবর্তী এলাকায় ইলিশ মাছ ধীরে ধীরে কমে আসছে। অনেকেই বাধ্য হয়ে এই পেশা ছেড়ে দিচ্ছেন।
আলীপুর এফবি মায়ের দোয়া ট্রলারের জেলে আঃ সালাম, জেলে রফিকুল, আবু সালেহ সহ একাধিক জেলের সাথে কথা হলে তারা জানান, আশা ছিলো ৬৫ দিনের অবরোধ শেষে সমুদ্রে গিয়ে প্রচুর ইলিশ পাবো। আর তা বিক্রি করে পরিবার নিয়ে মোটামুটিভাবে সংসার চালাবো এবং আড়ত মহাজনের দেনা পরিশোধ করবো। কিন্ত সেই আশা নিভে গেলো। উল্টো আরও দেনায় জর্জরিত হয়ে এখন হতাশায় ভুগছি। একদিকে দফায় দফায় বৈরী আবহাওয়া অন্যদিকে ইলিশ শুন্য সমুদ্র। এখন আবার ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা। আর সরকার যে পরিমান চাল দেয় তা দিয়ে ঠিকমতো ১৫ দিনও সংসার চলেনা।
আলীপুরের এফবি শুকতারা ট্রলারের মাঝি কবির জানান, আমাদের দেশের জলসীমায় অবরোধকালীন ভারতীয় এবং মায়ানমারের জেলেরা ফাঁকা সমুদ্রে মাছ শিকার করে নিয়ে যায়। আমরা বাংলাদেশীরা অবরোধ সঠিকভাবে পালন করলেও পার্শবর্তী দেশের জেলেরা ঠিকই আমাদের জলসীমায় এসে মাছ শিকার করছে। প্রশাসনের কোনো ভূমিকা আমরা লক্ষ্য করছি না। জেলেদের দাবি ভারতের সাথে একই সময়ে যেনো অবরোধের একই সময় নির্ধারণ করা হয়। মৎস্য বিভাগ, কোষ্ট গার্ড, নৌ পুলিশের আরো দায়িত্বশীল হলেই অবরোধ সফল হবে।
মাঝি সরোয়ার জানান, ট্রলারে কাজ করে গত বছর ৮০ হাজার টাকা ঋণ হয়েছে, তা এখনো পরিশোধ করতে পারিনি। জেলে ইউসুব জানান, উপকূল এলাকার ৯০ শতাংশ মানুষ মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ ককরি। বর্তমানে সমুদ্রে ঠিকমতো মাছ না পাওয়ার কারনে তিন বেলা দুমুঠো খেতে কষ্ট হয়। সাগরে মাছ ধরা হলেই আমাদের আয়ের পথও বন্ধ হয়ে যায়।
মহিপুর মৎস্য বন্দরের মৎস্য আড়তদার সমবায় সমিতির সাধারন সম্পাদক রাজা মিয়া বলেন, দক্ষিণের এ মৎস্য বন্দরে প্রায় কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ রয়েছে। মৎস্য ভিত্তিক অর্থনীতি সুরক্ষায় জেলেদের পেশা টিকিয়ে রাখতে সরকারকে খাদ্য সহায়তার পরিমাণ বৃদ্ধিসহ আর্থিক সহায়তা প্রদান করার দাবি জানান তিনি।
কুয়াকাটা-অলীপুর মৎস্য ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মোঃ আনছার উদ্দিন মোল্লা বলেন, মা ইলিশ সংরক্ষন করা গেলে বাড়বে মাছের উৎপাদন। যার সুফল ভোগ করবে জেলেসহ ব্যবসায়ীরা। অধিকাংশ জেলে এখন সচেতন হয়েছে। তবে অবরোধকালীন জেলেদের যে সহায়তা দেয়া হয় তা খুবই নগন্য। জেলেদের সহায়তা বাড়াতে সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করছি।
উপজেলা মৎস্য বিভাগ সূত্র জানায়, আন্ধারমানিক ও রামনাবাদ চ্যানেল সংলগ্ন উপকূল থেকে ৫ কিলোমিটার পর্যন্ত ডুবোচর সৃষ্টি হয়েছে, যে কারণে ইলিশ তাদের গতিপথ পরিবর্তন করেছে। কুয়াকাটার উপকূলের জেলেদের জন্য মাছ শিকারে ভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে। তালিকা যাচাই-বাছাই প্রসঙ্গে উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা অপু সাহা জানান শিগগিরই প্রকৃত জেলেদের তালিকা হালনাগাদ করা হবে।
পটুয়াখালী জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোঃ কামরুল ইসলাম জানান, বিগত কয়েক বছরে ইলিশের প্রজনন মৌসুমে মৎস্য শিকারের নিষেধাজ্ঞার ধারাবাহিকতায় বঙ্গোপসাগরে বেড়েছে রূপালী ইলিশসহ নানা প্রজাতির মাছ। অবরোধ সফল করতে জেলেদের নিয়ে উঠান বৈঠকসহ করা হয়েছে ধারাবাহিক গনসংযোগ। সমুদ্রসহ স্থলভাগে সক্রিয় রয়েছে প্রশাসন ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থা।
১২ অক্টোবর (বুধবার) মধ্যরাত থেকে শুরু হওয়া ২২ দিনের অবরোধ চলবে ২ নভেম্বর (বৃহস্পতিবার) ২০২৩ পর্যন্ত। এসময়ে ইলিশ সহ সামুদ্রিক সকল ধরনের মাছ শিকার, আহরন, পরিবহন, বাজারজাত করনসহ ক্রয়- বিক্রয় নিষিদ্ধ এবং একইসাথে মা ইলিশ সংরক্ষণ অভিযান বাস্তবায়ন করা হবে।
আইন অমান্যকারীকে এক থেকে সর্বোচ্চ ২ বছরের জেল অথবা সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দন্ড হতে পারে।
তবে নিষেধাজ্ঞা চলাকালীন জেলেদের জন্য (ভিজিএফ) আওতায় খাদ্য সহায়তা করা হলেও অধিকাংশ জেলে ট্রলার গুলোকে সমুদ্রে মাছ শিকার করতে দেখা যায়। বিগত দিনে নিষেধাজ্ঞাকালীন সময়ে প্রশাসনের দু’একটি জটিকা অভিজান করা ছাড়া যথাযথ ভূমিকা নিতে দেখা যায়না। যদি প্রশাসনের পক্ষ্য থেকে সঠিকভাবে অভিযান পরিচালনা করা হয় তবে এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হবে। অন্যথায় অবরোধ অর্থহীন এমন অভিমত সচেতন মহলের।
মন্তব্য করুন